রোবট ও রোবটিক্স

বিশ্বে এখন চলছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। প্রযুক্তির শক্তিতেই শিল্পবিপ্লব ঘটে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মূলত তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল বিপ্লব। এটি আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। চতুর্থ বিশ্ব বিপ্লবটিতে ব্যবহৃত হচ্ছে রোবট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো প্রযুক্তি ও বায়োটেকনোলজি। আমাদের আজকের বিষয় হলো রোবট ও রোবটিক্স।

বর্তমানে রোবট বিষয়টি সবার মুখে মুখে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে। কিছুদিন আগে রোবট সোফিয়ার আবির্ভাব সারাবিশ্বে আরও ব্যপকভাবে আলোড়ন তুলে। মঙ্গল গ্রহ কিংবা মহাকাশ অভিযান, শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা খাবারের দোকান পরিচালনা কিংবা বাসা – বাড়ির কাজ সবখানে দেখা যাচ্ছে রোবটের পদচারণ। এটির নিখুঁত কর্ম পরিচালনার সুখ্যাতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। পৃথিবীব্যাপী রোবটের অগ্রগতি প্রতিনিয়ত প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। রোবট মূলত বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে মানুষের সেবাদান করে থাকে। যেমন, যানবাহন ও গাড়ির কারখানায় বিপজ্জনক বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়করণ কাজ, শিল্পক্ষেত্রে কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের কাজ, গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তার কাজ, ঘরের প্রাত্যহিক কাজকর্ম, চিকিৎসা ক্ষেত্রে জটিল সব অপারেশনে সার্জনদের সাহায্য সহ নানা ধরনের কাজ এই রোবট প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজভাবে সম্পন্ন করা যাচ্ছে। এমনকি বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরী রোবট যুদ্ধাস্ত্র বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীতে বিশাল ভুমিকা পালন করছে। প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে পারার সক্ষমতা থাকছে বলে রোবটের কদর দিন দিন শুধু বেড়ে ই চলেছে। এবং পৃথিবীবাসীর জন্য রোবটের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে। যেমন, বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারীর সময় মানুষের মাঝে দূরত্ব রক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়েছিলো এবং এখনও রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা ক্ষেত্রে হয় ব্যতিক্রম ঘটনা। রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে অনেক চিকিৎসক কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং এখনও যাচ্ছেন। এ সময় যদি রোগীর চিকিৎসায় রোবট ব্যবহার করা যেত, তাহলে অনেক চিকিৎসকের জীবন রক্ষা পেতো। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর মহামারীতে মারা গেছেন প্রায় দেড়শ চিকিৎসক। সোফিয়া রোবট এর উদ্ভাবক এবং ‘হ্যানসন রোবটিক্স’ নামের কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ডেভিড হ্যানসন এক বক্তব্যে তিনিও বলেন, “করোনা মহামারীর এই সময়ে মানুষকে নিরাপদ রাখতে আরো বেশি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার প্রয়োজন। এই সময়ে রোবট কেবল স্বাস্থ্যসেবাই নয়, খুচরা পণ্যবিক্রির দোকান থেকে শুরু করে এয়ারলাইন্সের টিকিট বিক্রি এবং অন্যান্য কাজেও সহযোগিতা করতে পারতো। এতে করে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে মানুষ নিরাপদে থাকতে পারতো।”

রোবট ও রোবটিক্স এর পার্থক্য

প্রথমেই জেনে নেয়া যাক, রোবট ও রোবটিক্স কি? রােবট হলাে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বা যন্ত্রমানব। এটি মানুষের জন্য দুঃসাধ্য ও কঠিন কাজগুলো খুব সহজেই করতে পারে। রােবট মানেই যে মানুষের মতাে যন্ত্র হতে হবে তা নয়! রােবট এমন একটি যন্ত্র যা কখনাে সম্পূর্ণরূপে বা অংশগত দিক থেকে মানুষকে নকল করবে। কখনাে গঠনে, কখনাে কর্মে, কখনাে আবার দু’ভাবেই।
এবং রোবোটিক্স হলো রোবট প্রযুক্তির একটি বিশাল শাখা। এটির মূল বিষয় ই হলাে রােবটকে ঘিরে। রোবোটিক্স বা রোবটবিজ্ঞান হলো কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রসমূহ এর ডিজাইন ও উৎপাদন সংক্রান্ত বিজ্ঞান। এখানে রোবোটের গঠন, কাজ, বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করা হয়। রোবটিক্স এর শাখাটি ইলেকট্রনিক্স, প্রকৌশল, বলবিদ্যা, মেকানিক্স এবং সফটওয়্যার বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তবে এটির মৌলিক বিষয়গুলাে হলাে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মনােবিদ্যা। রোবোটিক্সে রােবটসমূহের ডিজাইন, নির্মাণ, কার্যক্রম, প্রয়ােগ নিয়ন্ত্রণ, সেন্সর ফিডব্যাক এবং তথ্য প্রক্রিয়াকরণ কাজগুলো করা হয়।

রোবট ও রোবটিক্স শব্দের উৎপত্তি

রােবােটিক্স শব্দটি এসেছে ‘রােবট’ শব্দ থেকে এবং রোবট শব্দটি এসেছে স্লাভিক শব্দ ‘Robota’ থেকে, যার অর্থ হলো শ্রমিক। ১৯২০ সালে চেকোস্লোভাকিয়ান নাট্যকার কারেল চাপেক (Karel Capek) সর্বপ্রথম তার নাটকে “রােবট” শব্দটি ব্যবহার করেন। নাটকটির নাম ছিল Rossum’s Universal Robots (RUR)। এরপর দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ১৯৪১ সালে বিখ্যাত মার্কিন কল্পবিজ্ঞান গল্পকার আইজাক অ্যাসিমভ তার ছােটগল্প ‘Lira’ তে সর্বপ্রথম রােবটিক্স শব্দটির ব্যবহার করেন। তিনি তাঁর গল্পে কাল্পনিক মেশিন ও এটির কাজ সম্পর্কে লিখেছিলেন। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি অনুযায়ীও এ তথ্য পাওয়া যায়।

রোবট এর সূচনা

রোবট সম্পর্কে ধারণা বা মতপ্রকাশ বহুকাল আগে থেকে প্রচলন শুরু হয়েছিলো। যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৩২০ বছর আগে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টোটল রােবট বিষয়ক একটি সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। তার মতে, “যদি কোনো যন্ত্রাংশকে আদেশ দিয়ে বা তার নিজের ইচ্ছায় কোনাে কাজ সম্পন্ন করতে পারে তখন প্রশিক্ষকের জন্য প্রশিক্ষণার্থী বা প্রভুর জন্য চাকরের প্রয়ােজন হবে না।” এখানে মূলত রোবটকেই উল্লেখ করেছিলেন তিনি। সুতরাং এ থেকেই বোঝা যায়, রোবট নিয়ে চিন্তাধারার উৎপত্তি প্রাচীন বিশ্বেই। এরপর রোবট যন্ত্র গঠন এর সূত্রপাত ঘটে। একদম শুরু থেকে বলতে গেলে দ্বাদশ শতক থেকে আসতে হবে, তখন চলছে ইসলামি স্বর্ণযুগ। মধ্যযুগের যে সময়ে ইউরোপ ডুবেছিল অন্ধকারে, সেসময় জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আরব পারস্যের পলিম্যাথগণ অবদান রাখছিলেন অসাধারণভাবে। এমনই একজন ছিলেন বদিইউজ্জামান আবুল ইজ ইবনে ইসমাইল ইবনে রাজ্জাজ আল জাজারি, যিনি সংক্ষেপে আল জাজারি নামে সুখ্যাত। তাকে ফাদার অব রোবটিক্স ও বলা হয়। তিনি তৈরী করেছিলেন সে সময়ের অত্যাশ্চর্য এলিফ্যান্ট ক্লক, যেটি একা একাই অপারেট করতে পারতো এবং ঠিকভাবে ২৪ ঘণ্টা সময় দিতে পারতো। এছাড়াও তিনি আরো ৫০টি মেকানিক্যাল ডিভাইস তৈরি করেছিলেন। এরপর আধুনিক রোবটের সূত্রপাত হয় শিল্প বিপ্লবের পর। জটিল আচরনের প্রথম ইলেক্ট্রনিক স্বায়ত্তশাসিত রোবট তৈরি করা হয় ১৯৪৮ সালে। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল ব্রিডল নিউরোলোজিকাল ইন্সটিটিউটের উইলিয়াম গ্রে ওয়াল্টার তৈরী করেন এই রোবট। এরপর বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামেবল রোবট তৈরী হয়, যেটির নাম ছিলো ‘Unimate’। এই সর্বপ্রথম ডিজিটাল ও প্রোগ্রামেবল রোবট আবিষ্কার করেন জর্জ ডিভোল নামক এক বিজ্ঞানী, তিনি ই এটির নাম দেন ইউনিমেট। এটি ছিল প্রায় ১ টন ওজনের এক জায়ান্ট রোবটিক হাত, যেটি প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ করতে পারতো। ১৯৬১ সালে তিনি এটি জেনারেল মোটরস নামক একটি কোম্পানীর কাছে বিক্রি করে দেন। কারণ ইউমিনেটের কাজ ছিল ভারী লোহা ওঠানামা করানো আর ভারী কোন বস্তু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা। ইউনিমেটের হাত ধরেই শুরু হয় বিশ্বের প্রথম আধুনিক স্বয়ংক্রিয় রোবটের যাত্রা। ইউনিমেট এর আবির্ভাবে কার কোম্পানিগুলোর মাঝে রোবট তৈরির হুলস্থূল পড়ে যায়। কিন্তু সেসময় সেগুলো বেশ ভারী থাকায় অপারেট করা কঠিন ছিল। ১৯৭৪ সালে যখন আইআরবি-৬ আসে, সেটি বেশ উন্নত ছিলো। কারণ এটি প্রথমবারের মতো মাইক্রোকম্পিউটার দিয়ে নিয়ন্ত্রিত যোগ্য ছিলো। কিন্তু সেই দশকে যে সমস্যাটি হতো, তা হলো যন্ত্রগুলো উন্নত হচ্ছিলো কিন্তু বাস্তব জগতের সাথে ইন্টার‍্যাক্ট করতে যন্ত্রগুলোর বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো। যেমন, না দেখে রোবটগুলো কাজ করায় অনেককিছু ঠিকভাবে করতে পারতো না। এরপর আশির দশকে মেলে আলোর দেখা। প্রথমবারের মত ‘Vision” অর্থাৎ দেখার ফিচার যুক্ত করা হয় রোবটে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি বিজ্ঞানীদের। বাকি দুই দশকব্যাপী শুধু চলছে অসাধারণ এই উৎকর্ষ সাধনের মহোৎসব। ২০০০ সালের পর থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের মাধ্যমে আধুনিক নিয়ন্ত্রিত শিল্প রোবট নির্মান করা শুরু হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে যুক্ত ভিশন এবং অন্যান্য সেন্সর ফিচার এর ফলে রোবটগুলো কর্মে আরও উন্নতি করে। এই ফিচারগুলোর সুবাদে, ২০০৪ সালে কার্নেল ইউনিভার্সিটি প্রথম একটি রোবট প্রকাশ করে যেটি স্ব-প্রতিক্রিয়ায় সক্ষম হয়। এটি ই বিশ্বের প্রথম রোবট যা নিজেই নিজের প্রথম কপি করতে সক্ষম ছিল। এরপর অনেক অনেক রোবট আবিষ্কার হয়। এর ফাঁকে বিজ্ঞানীগণ বুঝতে পারেন, রোবট সবচেয়ে ভালো কাজ করতে পারে যদি এটিকে কোনো নির্দিষ্ট কাজের জন্য বানানো হয়। এ লক্ষ্যেই গত পনেরো বছরে বাসাবাড়ি, মিল কারখানার কাজে সাহায্য করার উপযোগী অনেক অনেক রোবটের আবিষ্কার হয়েছে। যেমন রুমের ময়লা পরিষ্কার করা, ঘাস কাটা, জানালা পরিষ্কার করা, সুইমিং পুল পরিষ্কার করা, ভারী বস্তু ওঠানো সহ আরও অন্যান্য অনেক কাজে রোবটের উদ্ভব ঘটেছে ভুরিভুরি। সবশেষে যে রোবটটির কথা বলতে ই হবে, সেটি হলো সোফিয়া। সৌদি আরব কর্তৃক নির্মিত মানব আকৃতির এই রোবট চালু হয় ২৫ অক্টোবর এর ২০১৭ সালে। এটি বিশ্বের প্রথম রোবট যা কোন দেশের নাগরিকত্ব লাভ করে। এটি সামাজিক যোগাযোগ সক্ষম রোবট। রোবটটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যে, সে মানুষের ব্যবহার ও আচরণের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে, নতুন কিছু শিখতে পারবে এবং মানুষের সাথে কাজ করতে পারবে।

রোবট এর উপাদানসমূহ

রোবট একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। এটির নিজস্ব কোন বুদ্ধিমত্তা নেই। এটির মেমোরিতে কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাহায্যে নির্দিষ্ট কিছু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) সেট করে দেয়া হয়। প্রোগ্রাম অনুসারে রোবটটি তার নির্দেশিত কাজটি সম্পন্ন করে। এটির রয়েছে কিছু মৌলিক উপাদান। সেগুলো হলো :-

  • মস্তিষ্ক বা প্রসেসর (Processor) :- মানব মস্তিষ্ক হল এমন একটি অঙ্গ যেখানে বুদ্ধিমত্তা সঞ্চিত থাকে এবং প্রয়োজন মোতাবেক দিক নির্দেশনা প্রদান করে। ঠিক তেমন ই হলো রোবট এর প্রসেসর। এটি একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে রোবটকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সমস্ত নির্দেশিকা কম্পিউটার প্রোগ্রাম এর সাহায্যে স্থাপন করা হয়।
  • ব্যাটারি বা পাওয়ার সিস্টেম (Battery or Power System) :- একটি রোবটকে সচল রাখার জন্য ইলেকট্রিক পাওয়ার প্রদান করতে হয়। যার জন্য প্রয়োজন একটি পাওয়ার সিস্টেম বা ব্যাটারির। পাওয়ার প্রদানের জন্য সাধারণত লেড এসিড ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়। এই ব্যাটারি রিচার্জেসন অর্থাৎ পুনরায় চার্জ করা যায়।
  • অ্যাকচুয়েটর (Actuator) :- অ্যাকচুয়েটর হলো বৈদ্যুতিক মটরের সাহায্যে তৈরী একধরনের বিশেষ যান্ত্রিক ব্যবস্থা যা রোবটের হাত পা অথবা বিশেষভাবে তৈরি কোন অঙ্গ প্রতঙ্গের নড়াচড়া করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটিকে রোবটের হাত ও পায়ের পেশি বলেও অবহিত করা যায়।
  • সেন্সর (Sensor) :- অনুভূতি মানুষের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। রোবটের মাঝে সেন্সরের মাধ্যমে মানুষের মত অনুভূতি তৈরি করা হয়। এটি রোবটের বিশেষ একটি উপাদান যার সাহায্যে রোবট তার আশেপাশে অবস্থান করা যেকোন বস্তু সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এবং এসব তথ্য একটি রোবটের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মূলত রোবটের হাত বা পা কোনো একটি জায়গায় স্পর্শ করলে সেই জায়গা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য নেওয়ার ক্ষমতা থাকে।
  • ম্যানিপুলেশন (Manipulation) :- ম্যানিপুলেশন হলো রোবটের অবস্থান পরিবর্তন করার ক্ষমতা। পরিবর্তন করার পদ্ধতিকে বলা হয় ম্যানিপুলেশন। এটির সাহায্যে একটি রোবট হাতের আঙুলের দ্বারা বস্তু ধরতে পারে ও স্থানান্তর করতে পারে, তেমনি তার পায়ের দ্বারা সামনে পিছনে বা ডানে বামে চলাচল করতে পারে।

রোবট এর ক্ষেত্রসমূহ

বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রােবটকে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাই এটিকে শ্রেণিবদ্ধ করা সহজ নয়। প্রতিটি রোবটের নিজস্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং তাদের আকার ও ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। নিম্নে রোবটের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রেনিবদ্ধ করা হলো:

  • ম্যানুফ্যাকচারিং কাজে
  • ঝুঁকিপূর্ণ/বিপজ্জনক কাজে
  • ভারী শিল্প কারখানায়
  • শিল্পের বিপজ্জনক ও কঠিন কাজে
  • বৃহৎ মেশিনের যন্ত্রপাতি সংযােজনে
  • সঠিক পরীক্ষার কাজে
  • মেইল ডেলিভারির কাজে
  • নিরাপত্তার কাজে
  • পুলিশের সাহায্যকারী হিসেবে
  • সামরিক ক্ষেত্রে
  • ঘরোয়া কাজে
  • চিকিৎসায়
  • মহাকাশ গবেষণায়
  • মহাশূন্যের ছবি সংগ্রহে
  • খনি হতে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ উত্তোলনে
  • ক্ষতিকর বিস্ফোরক সনাক্তকরণে
  • গভীর অরণ্যে গবেষণার কাজে

এছাড়াও আরও অনেক অনেক কাজে রোবটের ব্যবহার হচ্ছে সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিন দিন রোবটের ব্যবহার খুব দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে।

সম্প্রতি বিশ্বে কিছু রোবট এর বিপ্লব সাফল্য

বর্তমান বিশ্বে রোবটের ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে তুমুল হারে। মানুষের জীবনযাত্রা সহজতর করার লক্ষ্যে রোবোটিক্স বা রোবট বিজ্ঞানে প্রতিদিন নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। রোবোটিক্স বিষয়ক আন্তর্জাতিক ফেডারেশন এর এক রিপোর্টে জানা যায়, ২০১৮ ও ২০১৯ সালের সময়ে পেশাদার কাজে সহযোগিতা সক্ষম রোবট বিক্রির তুলনায় বর্তমানে ৩২ শতাংশ বেড়েছে। মূলত ২০২০ সালে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর রোবটের ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে। রোবট ব্যবহারে বিভিন্ন কর্মস্থানে ফলাফল স্বরূপ ব্যপক সাফল্যও পাওয়া গিয়েছে। সম্প্রতি সারাবিশ্বে সাড়া জাগানো কিছু রোবট নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো :-

– চীনের ‘গিকপ্লাস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি নতুন স্বচালিত রোবোট উদ্ভাবন করেছে। এই রোবোটগুলো ওয়্যারহাউজের ভেতরে নিজে নিজে চলতে পারে, ঘরের মেঝেতে বসানো কিউআর (QR) কোডের নির্দেশনার মাধ্যমে। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তারা কোনদিকে যেতে হবে, কী কাজ করতে হবে, আবার কোন পথে নিজের জায়গায় ফিরে আসতে হবে তা বুঝে নিতে পারে। সেইসাথে রোবোটগুলো নানা ধরনের পণ্য তাকে সাজিয়ে রাখতে পারে, অর্ডার এলে সেখান থেকে সংগ্রহ করে আনতে পারে, ডেলিভারি ভ্যানে তুলে দিতে পারে এবং পণ্যের হিসাব রাখতে পারে। এখানে সবচেয়ে মূল বিষয়টি হলো, এটি ‘মানবিক ভুল’ করে না। এর ফলে পণ্য সরবরাহ দ্রুততর হয়। ‘গিকপ্লাস’ এরই মধ্যে এ ধরনের দেড় হাজার রোবোট তৈরি করে ৩০ টির বেশি দেশে সরবরাহ করেছে। গিকপ্লাস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিট ফাং বলেছেন, “সবাই নিজেদের ওয়্যারহাউজে এ ধরনের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করার জন্য মুখিয়ে আছে। একেকটি ওয়্যারহাউজের আয়তন একটি ফুটবল মাঠের চেয়ে কয়েক গুণ বড়। সেখানে বহু মানুষকে কাজ করতে হয়। কিন্তু সেই বহু মানুষের কাজ করে দিচ্ছে মাত্র কয়েকটি রোবোট।”

– জাপানের কোম্পানি “টেলিএক্সিসটেন্স” এর তৈরি করা সাত ফুট উঁচু মডেল এর রোবোটগুলো টেকিওর দুটি বৃহত্তম ওয়্যারহাউজে পণ্য সাজিয়ে রাখার কাজ করে থাকে। এসব রোবোটের সাথে ক্যামেরা, মাইক্রোফোন ও নানা ধরনের সেন্সর লাগানো আছে। এদের হাতে তিনটি করে আঙুল আছে যেগুলো দিয়ে ড্রিঙ্কস এর বোতল, ক্যান, জার ইত্যাদি জায়গা মতো রাখতে পারে। দূর থেকে কিংবা বাড়িতে বসে মানুষ কর্মচারীরা এই রোবোটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

– হংকং এর একটি ওয়্যারহাউজে একদল রোবোট কাজ শুরু করেছে যেগুলো স্বয়ংচালিত। এগুলো দিনরাত টানা কাজ করতে পারে এবং কোনো সাপ্তাহিক ছুটিরও দরকার হয় না এদের। শুধু তাই নয়, যন্ত্রগুলো যত বেশি কাজ করে ততই এটি নিজের কাজের অভিজ্ঞতা নিজের ভেতরে সঞ্চয় করে নিতে পারে। অর্থাৎ, যন্ত্রটি নিজে নিজেই আরও বেশি চৌকস হয়ে উঠতে পারে। সিএনএন এর এক রিপোর্টে বলা হয়, রোবোটের পাল দারুণ কাজ দেখিয়েছে। হংকংয়ের ওয়্যারহাউজটিতে গত চার মাসে ১০ লাখের বেশি বিভিন্ন ধরনের পণ্য সরবরাহ করতে পেরেছে।

– মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় এর এমআইটি একটি রোবোট বানিয়েছে যেটি মেঝে পরিষ্কারের কাজ করে। চার হাজার বর্গফুটের একটি ওয়্যারহাউজের মেঝে পরিষ্কার করে মাত্র আধ ঘণ্টায়। অর্থাৎ প্রায় ১৫-২০ জন মানুষের কয়েক ঘণ্টার কাজ একাই করে দেয় অল্প সময়ের মধ্যে। এছাড়াও এই রোবোটটির অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, এটি অতিবেগুনি রশ্মি ব্যবহার করে বিদ্যুৎচৌম্বকীয় বিকিরণজাত ফোমের সাহায্যে পুরো মেঝে জীবাণুমুক্ত করে থাকে।

– বাংলাদেশী তরুণ লাবিব তাজওয়ার রহমান এর একটি রোবট দক্ষিণ কোরিয়ায় মানুষের দোরগোড়ায় খাবার পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত রয়েছে।

এছাড়াও আমরা প্রায়ই সোশ্যাল মিডিয়া, খবরে কিংবা কল কারখানায় আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার দেখি। রোবোটিক একটি হাত কারখানায় গাড়ির যন্ত্রাংশ ঠিক করছে কিংবা খাদ্যসামগ্রীর কারখানায় বিপুল পরিমাণ খাদ্য টিন বা বোতলজাত করছে। মানুষের পরিবর্তে রোবোট ব্যবহার হচ্ছে বড় বড় ওয়্যারহাউজ বা গুদামে। যেমন, অ্যামাজন, নাইকি, আলিবাবার মতো বৃহৎ কোম্পানির গুদামগুলোতে হাজার হাজার রোবোট কাজ করছে।

রোবট এর সুবিধাসমূহ

  • রোবট প্রযুক্তি মানুষের কাজকে সহজ করে।
  • রোবটের কাজ করার গতি বেশি এবং আউটপুটও বেশি।
  • রোবট যন্ত্র নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যায়, ক্লান্ত হয় না।
  • বিরক্তিকর কিংবা একঘেয়ে কাজে হাঁপিয়ে ওঠে না। দীর্ঘক্ষন কাজ করতে পারে।
  • রোবট এর দ্বারা তৈরি পন্যের গুনগতমান খুব ভালো এবং সূক্ষতা বেশি হয়।
  • বিপজ্জনক পরিবেশে ঝুঁকিহীনভাবে কাজ করানো যায়।
  • রোবট এমন সব কাজ করতে পারে, যা মানুষের দ্বারা করা সম্ভব নয়।

রোবট এর সুবিধা বলে শেষ করা যাবে না। মানবজীবন সহজ থেকে সহজতর করে দিয়েছে রোবট প্রযুক্তি। দাবা খেলা থেকে শুরু করে হাসপাতালের সার্জারি, সাবমেরিন থেকে মহাকাশ, গাড়ি বানানো থেকে শুরু করে ঘরের সকল কাজ, সব জায়গায় রয়েছে এটির অবদান। এছাড়াও বোমা নিষ্কাশন, ভারী বস্তু উত্তোলন, বৈদ্যুতিক সংযোগ স্থাপন সহ আরও অনেক ঝুকিঝুকিপূর্ণ কাজে রয়েছে রোবট এর ব্যবহার। রোবট প্রযুক্তি যেন মানব জীবনে আশীর্বাদ স্বরূপ।

রোবট এর অসুবিধাসমূহ

পৃথিবীর যেকোনো কিছুর ভালো ও মন্দ দুটি দিক ই থাকে। তেমনটি রোবট প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও। রোবট আমাদের নানা কাজে সাহায্য করলেও এর কিছু খারাপ গুণ রয়েছে। সেগুলো হলো :-

  • মানুষের মতো চিন্তাভাবনা করে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে পারে না। যে সকল কাজের নির্দেশনা প্রোগ্রামের মাধ্যমে সেট করে দেয়া হয় শুধু সেই কাজগুলো ই করতে পারে।
  • এটির কোন সৃজনশীলতা নেই।
  • এটি শুধু সেট করে দেয়া প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ করে। কাজটি সঠিক নাকি ভুল, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারে না।
  • কোনো আকস্মিক পরিবর্তিত পরিবেশের পরিস্থিতি মানিয়ে নিয়ে কাজ করতে পারে না, যদি না সেট করে দেওয়া প্রোগ্রাম পরিবর্তন করা হয়।
  • নতুন জটিল পরিস্থিতিতে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না।
  • রোবট ব্যবহার বর্তমানে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এটির ব্যবস্থাপনা এখনও সহজ সাধ্য হয়নি।
  • রোবট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষ লোকের প্রয়োজন হয়।
  • রোবটকে সচল রাখতে অধিক বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়।
  • রোবট ব্যবহারের ফলে ধীরে ধীরে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। এতে বেকারত্ব বাড়ছে, মানুষ ধীরে ধীরে তার কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেলছে।

ধারণামতে, উপরে উল্লেখিত সব সমস্যার সমাধান প্রযুক্তি কল্যাণে সাধন করা সম্ভব। কিন্তু মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক নীতি গবেষণা কেন্দ্র ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাদের এক বৈশ্বিক আলোচনা সভায় জানিয়েছে, “রোবটের অত্যধিক ব্যবহারের কারণে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্ব জুড়ে চাকরি হারাবে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি কর্মজীবী মানুষ।” অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানীর ভাষ্যমতে, “আগামী ৫০ বছরের মধ্যে মানুষের অর্ধেক কাজ এবং ১২০ বছরের মধ্যে মানুষের সব কাজ সম্পন্ন হতে পারবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অত্যাধুনিক রোবটের মাধ্যমে।” তাহলে ধীরে ধীরে সকল কর্মস্থান রোবট দ্বারা দখল হয়ে গেলে মানবজাতি কি করবে? কথায় আছে, “বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।” তাই এই আশীর্বাদপূর্ণ বেগ যেন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পৃথিবীর বুক থেকে মানব জাতির বিলুপ্তির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সবাইকে থাকতে হবে সর্বোচ্চ সতর্ক। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে রোবট প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে একযোগে। বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় তৈরী রোবট প্রযুক্তি হয়ে উঠুক মানুষের দুঃসময়ের পরম বন্ধু। সাহায্য, সহযোগিতা ও নিরাপদ আশ্রয়ের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।

এই ছিলো রোবট ও রোবটিক্স সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। যেকোনো প্রশ্ন জাগলে নির্দ্বিধায় কমেন্টবক্সে কমেন্ট করুন। এবং টেকনোলজি সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। সেইসাথে আমাদের অন্যান্য আর্টিকেলগুলোও পড়তে পারেন। ধন্যবাদ।