বর্তমান পৃথিবী চলছে ইন্টারনেটের ওপর ভর করে। আর এই ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে আমূল বদলে ফেলে নতুনত্ব আনতে যাচ্ছে ইলন মাস্কের স্টারলিংক ইন্টারনেট। অর্থাৎ ইন্টারনেট জগৎ দখলের পথেও চলে এলেন ইলন মাস্ক। বিশ্বের শীর্ষ ধনী হলেন ইলন মাস্ক এর কথা উঠলে তার নেতৃত্বে থাকা ইলেক্ট্রিক কার কোম্পানি টেসলা ও তার স্পেস এক্সপ্লোরেশন ভেনচার স্পেসএক্স এর কথাও চলে আসে। এছাড়াও তিনি স্টারলিংক (Starlink) নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন। যেটির সম্পর্কে অনেকেই জানে না। স্পেসএক্সের সহপ্রতিষ্ঠান স্টারলিংক পৃথিবীর দ্রুত বিকাশমান বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, এটি পৃথিবীর লো-অরবিটে থাকা স্যাটেলাইট থেকে বিশ্বব্যাপী লো লেটেন্সির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদান করবে।
ইন্টারনেটের এই যুগে এসেও বহু মানুষ ইন্টারনেট থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের মোট ৭৯০ কোটি মানুষের মধ্যে ৪৬০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। অর্থাৎ প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো ইন্টারনেট সেবার আওতার বাইরে রয়েছে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক লোক ইন্টারনেট বঞ্চিত থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হলো, সব জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগ নেই। এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে সহজে ইন্টারনেট-সেবা দেওয়ার জন্য বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক তার স্টারলিংক ইন্টারনেট কোম্পানির যাত্রা শুরু করেছেন। স্টারলিংক পৃথিবীর নিকট মহাকাশে প্রায় ৪২ হাজার স্যাটেলাইট স্থাপন করে পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় কোনায় দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করবে।
বর্তমানে পৃথিবীর ইন্টারনেট ব্যবস্থা সমুদ্রের নিচ দিয়ে স্থাপিত তারের সাহায্যে যুক্ত। এই তারকে বলা হয় “সাবমেরিন ক্যাবল”। এটি হলাে অপটিক্যাল ফাইবারের বৃহদাকার সংযােগ, যা সমুদ্র তলদেশে ক্যাবল বা তারের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশের টেলিকমিউনিকেশনের মধ্যে সংযােগ স্থাপন করে। সমুদ্রের তলদেশে স্থাপিত হওয়ায় এর নামকরণ করা হয়েছে সাবমেরিন ক্যাবল। সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন এবং রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ব্যয়বহুল এবং এই ক্যাবলে নিয়মিত নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়াও পৃথিবীর বহু জায়গায় এই সাবমেরিন কেবল পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ঠিক এই কারণে আজও দুর্গম ও অনুন্নত এলাকা ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত। কাছাকাছি সংযোগের জন্য যে, ফাইবার অপটিক ক্যাবল ব্যবহার করা হয় তাতে আলো-সংকেত ব্যবহার করে ডাটা আদান-প্রদান করা হয়। কিন্তু অপটিক্যাল ফাইবারে আলোকে গ্লাস মিডিয়ামের ভেতর দিয়ে যেতে হয় বলে আলোর গতি প্রায় ৪০% পর্যন্ত কমে যায়। যার ফলে ডাটা ট্রান্সফার ধীর গতিতে হয়। এই সকল সমস্যার সমাধান করা যায় স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট ব্যবহার করে। অতীতে বেশকিছু কোম্পানি স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট প্রদান করেছে। কিন্তু সেসব স্যাটেলাইট ইন্টারনেটেরও ছিলো সীমাবদ্ধতা। এই কাজে ব্যবহৃত স্যাটেলাইটগুলো হলো জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট। এই স্যাটেলাইট পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরের কক্ষপথে স্থাপন করতে হয় এবং এটি সেখানে স্থির থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবী থেকে অনেক দূরে অবস্থান করার কারণে এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কোনো তথ্য আদান-প্রদান করতে হলে অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। এজন্য স্পিড কম হয় এবং ল্যাটেন্সি হয় অনেক বেশি। যার ফলে এই স্যাটেলাইট ইন্টারনেটও জনপ্রিয় হতে পারে নি। প্রথমত ধীর গতির ইন্টারনেট দ্বিতীয়ত এই ইন্টারনেটের খরচ অনেক ব্যয়বহুল, এজন্য এই ইন্টারনেট ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যবহার কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। এমনকি বেশিরভাগ ছোটখাটো কোম্পানির পক্ষেও এই স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের ব্যয় বহন করা সম্ভব হয় না।
এরপর ই এত সব সমস্যার মাঝে নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পান বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক। তিনি কম খরচে দ্রুত গতির স্যাটেলাইট ইন্টারনেট-সেবা দেওয়ার জন্য স্টারলিংক প্রজেক্ট শুরু করেন। স্যাটেলাইট এর বিশাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পুরো পৃথিবীতে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিতে কাজ করবে স্টারলিংক। লো-অরবিটে অবস্থিত স্যাটেলাইট দিয়ে সারা বিশ্বে লো লেটেন্সির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদান করবে এটি। লো-অরবিট স্যাটেলাইট হলো এমন একধরনের স্যাটেলাইট, যেগুলো জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইটের মতো অনেক দূরে না থেকে পৃথিবীপৃষ্ঠের অনেকটা কাছাকাছি থাকে, এবং এই স্যাটেলাইটগুলো একটা জায়গায় স্থির না থেকে অনবরত দ্রুতগতিতে স্থান পরিবর্তন করে। এবং এটি দ্রুতগতিতে চলার কারণে এদেরকে নির্দিষ্ট একটা হিসাব-নিকাশ করে সাজানো হয়, যেন এরা একে অপরের সাথে সংঘর্ষ ঘটাতে না পারে। লো-অরবিট স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৫০০-১০০০ কিলোমিটার উপরে থাকে। অত্যন্ত কাছাকাছি অবস্থান করার কারণে এই স্যাটেলাইটগুলো দিয়ে দ্রতগতিতে ডাটা আদান-প্রদান করা সম্ভব হয় এবং ল্যাটেন্সিও হয় অনেক কম। এবং লো-অরবিট স্যাটেলাইটগুলো একে অপরের সাথে যোগাযোগ এবং ডাটা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে লেজার-লাইট ব্যবহার করে। যেহেতু এক্ষেত্রে আলোকে গ্লাসের বদলে বাতাসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, তাই আলোর গতি কমে যায় না। আলো তার পূর্ণ গতিতে চলতে পারার কারণে ডাটা আদান-প্রদানের স্পিডও বেশি হয়। স্টারলিংক বা এটির মতো প্রজেক্টগুলোতে এই লো-অরবিট স্যাটেলাইট ই ব্যবহার করা হবে। যার ফলে জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইটের সমস্ত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে এটিকে ভবিষ্যতের ব্রডব্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। বর্তমানে লো-আরবিট স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটির লক্ষ্যে অনেকগুলো প্রজেক্ট এর কাজ চলছে। যেগুলোর তত্ত্বাবধানে আছে বিশ্বের নামি-দামি সব টেক কোম্পানি। যেমন:-
- SpaceX এর প্রজেক্ট StarLink
- Qualcomm-Airbus এর প্রজেক্ট OneWeb
- Amazon এর প্রজেক্ট Kuiper
আমাদের আজকের বিষয় হলো, বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা টেক-আইকন ইলন মাস্ক এর “প্রজেক্ট স্টারলিংক'” নিয়ে। ‘স্টারলিংক’ অন্য প্রজেক্টগুলোর মতোই একটি লো-অরবিট স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড প্রজেক্ট। স্টারলিংক হলো স্পেসএক্স এর একটি শাখা, যা অরবিট্যাল স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ করছে। একটি বৃহৎ স্যাটেলাইট ব্যবস্থার পাশাপাশি বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা প্রদানে এই প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে। ২০১৫ সালে স্টারলিংক স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক এর কাজ শুরু হয়। সেই সালে ইলন মাস্ক প্রথমবার স্টারলিংক এর কথা জানান বিশ্ববাসীকে। তিনি জানান, “স্টারলিংক হতে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী গ্লোবাল কমিউনিউকেশন সিস্টেম। এটির লক্ষ্য হলো, সারা পৃথিবীতে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়া।” এরপর ২০১৮ সালে তারা প্রথম প্রোটোটাইপ স্যাটেলাইট অরবিটে লঞ্চ করে। পরের বছরগুলোতে স্পেসএক্স সফলভাবে প্রায় ২০০০ স্টারলিংক স্যাটেলাইট অরবিটে লঞ্চ করে। ২০১৯ সালের জুন মাসে মাস্ক জানান যে, “দূরবর্তী ও কম ঘনত্বের এলাকাগুলোতে লো লেটেন্সি, হাই ব্যান্ডউইথ ইন্টারনেট সেবা প্রদান করবে স্টারলিংক। যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে যথেষ্ট স্পিডযুক্ত ব্যবস্থা নেই, তারাই হতে যাচ্ছেন স্টারলিংক এর গ্রাহক।” সে বছরের অক্টোবর মাসে ইলন মাস্ক সর্বপ্রথম স্টারলিংক ইন্টারনেট ব্যবহার করে একটি টুইট করেন। তার পরের বছর ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে স্টারলিংক ইন্টারনেট পরীক্ষামূলক ভাবে গ্রাহকদের সেবা প্রদান শুরু করে। স্টারলিংক প্রজেক্ট এর মূল নিশানা হলো, ৪২ হাজার স্যাটেলাইট দিয়ে পুরো পৃথিবী ঘিরে ফেলবে। ইতিমধ্যে প্রায় ১২ হাজার স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে লঞ্চ করেছে। ইলন মাস্কের একত্রে এত স্যাটেলাইট পাঠানোকে বলা হচ্ছে ‘স্যাটেলাইট ট্রেন’। এই ট্রেন দিয়েই পৃথিবীর প্রতিটি আনাচে-কানাচে ইন্টারনেটের রেঞ্জ তৈরি করা হবে। এবং পুরো দুনিয়াকে একই ইন্টারনেট প্রদান করবে স্টারলিংক। স্টারলিংক এর ওয়েবসাইটে প্রদত্ত তথ্যমতে, বেশিরভাগ স্থানে ৫০ থেকে ১৫০ মেগাবাইট পার সেকেন্ড ইন্টারনেট স্পিড পাওয়া যাবে ও লেটেন্সি ২০ থেকে ৪০ মিলিসেকেন্ডের মধ্যে থাকবে।
ইলন মাস্ক এর ভাষ্যমতে, স্টারলিংক ইন্টারনেট কাজ করবে স্টারলিংক টার্মিনাল এর ইন-বিল্ট মোটর ব্যবহার করে। এটি দেখতে পাতলা, ফ্ল্যাট ও ইউএফ এর মতো। এটি নিজে থেকে উপযুক্ত কোণে নিজেকে সেট করে নিতে পারবে। স্টারলিঙ্ক টার্মিনাল সেটাপ ইন্সট্রাকশনও বেশ সহজ। শুধুমাত্র সকেট প্লাগে লাগিয়ে আকাশের দিকে সেট করে দিতে হবে। টার্মিনালের ফ্ল্যাট আকৃতির অ্যারে এন্টেনাটি ১৯ ইঞ্চি থেকে ৪৮ সেমি আকৃতির হবে। এই এন্টেনাতে অনেকগুলো ছোটো এন্টেনা রয়েছে যেগুলো একত্র হয়ে সিগনাল আদান-প্রদানের কাজ করবে। স্টারলিঙ্ক কিটে একটি ডিশ এন্টেনা (টার্মিনাল), পিওই (power over ethernet) সাপ্লাই, ট্রাইপড মাউন্ট ও দুইটি ইথারনেট ক্যাবল থাকবে।
স্টারলিংক ইন্টারনেটের সুবিধা ও অসুবিধা সমূহ:-
সুবিধা
– স্টারলিংক ইন্টারনেট যে কোন জায়গা থেকে ব্যবহার করা যাবে।
– প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং দুর্যোগের সময় স্টারলিংক ইন্টারনেট ভালো পরিষেবা দিবে। কেবল তার না থাকায় দুর্যোগের সময় এটি সহজেই পুনরুদ্ধার করা যাবে।
– কখনো কখনো স্টারলিংক ইন্টারনেট এর গতি প্রতিশ্রুতির তুলনায় আরও বেশি দ্রুত হবে।
অসুবিধা
– স্টারলিংক ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো লেটেন্সি সমস্যা।
– এটি VPN সমর্থন করে না।
– স্টারলিংক ইন্টারনেটের দাম সাধারণ ইন্টারনেটের তুলনায় বেশি।
– স্টারলিংক ইন্টারনেট এর জন্য আকাশকে পরিষ্কার হতে হবে।
– প্রবল বৃষ্টি বা প্রবল বাতাস এর স্টারলিংক ইন্টারনেট কানেকশনে বিঘ্নিত করতে পারে। যা গতিকে প্রভাবিত করবে।
অসুবিধাগুলো নিয়ে ইলন মাস্ক জানিয়েছে, “সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন গ্রাউন্ড স্টেশন ইন্সটল করা হবে এবং নেটওয়ার্ক আপডেট করা হবে। যার ফলে ইন্টারনেট স্পিড, লেটেন্সি ও অন্যান্য সবদিকের আরও উন্নতি হবে।”
বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা
ইলন মাস্ক এর নতুন চমক স্টারলিংক ইন্টারনেট ইতিমধ্যে পরিষেবা শুরু করেছে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়। ইউক্রেনে চলমান রুশ অভিযানে দেশটির ইন্টারনেট ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছিলো। এরপর জরুরী ইন্টারনেট সেবার জন্য ইলন মাস্ক এর কাছে সাহায্য চায় দেশটির সরকার। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইউক্রেনের ইন্টারনেট সেবাকে নিরবচ্ছিন্ন রাখতে স্টারলিংক স্যাটেলাইট সক্রিয় করেন ইলন মাস্ক। এছাড়াও অসংখ্য নামি-দামি কোম্পানি স্টারলিংক ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করেছে। মাইক্রোসফট তাদের ক্লাউড কম্পিউটিং সার্ভিস Azure এর পরিচালনা করতে স্টারলিংক ইন্টারনেট ব্যবহার করতে চায়। সেজন্য মাইক্রোসফট এবং স্পেসএক্স এর মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশে এই স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা শুরু হওয়ার পাশাপাশি বিমানেও ওয়াইফাই সুবিধা দেয়ার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ইলন মাস্ক এর কোম্পানি স্টারলিংক। বিমান সংস্থা জেএসএক্স এর সঙ্গে এই চুক্তি করেছে স্টারলিংক। এই চুক্তির ফলে ১০০ টি বিমানে কোম্পানির টার্মিনাল বসাবে স্টারলিঙ্ক। তবে চুক্তির অঙ্ক দুই কোম্পানির তরফ থেকেই গোপন রাখা হয়েছে। ২০২১ সালে এক টুইট বার্তায় ইলন মাস্ক জানিয়েছিলেন, “একাধিক বিমান সংস্থার সঙ্গে ইন্টারনেট পরিষেবার চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আলোচনা শুরু করেছে স্টারলিংক।”
ইলন মাস্কের মহাকাশ সংস্থা ও স্টারলিংকের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স এর অফিসিয়াল টুইটবার্তায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেনের কিছু অংশসহ বিশ্বের ৩২টি দেশে স্টারলিংকের ব্রডব্যান্ড পরিষেবা চালু রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইলন মাস্কের বহুল আলোচিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা স্টারলিংক ইন্টারনেট ২০২৩ সালে বাংলাদেশে চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। স্টারলিংক ওয়েবসাইটে পোস্ট করা মানচিত্র থেকে জানা গিয়েছে এই তথ্য। সেখানে বলা হয়েছে ‘সেবার আওতাধীন’ চিহ্নিত দেশগুলো খুব তাড়াতাড়ি স্টারলিংক ইনস্টলেশন প্যাকেজ পাবে। এবং ম্যাপে ‘অপেক্ষাকৃত’ এবং ‘শীঘ্রই আসছে’ চিহ্নিত এলাকাগুলোও রয়েছে। ‘শীঘ্রই আসছে’ চিহ্নিত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, সৌদি আরব, পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশ। ম্যাপটিতে বাংলাদেশের নামের ওপর মাউস রাখলে “স্টার্টিং ২০২৩” দেখা যাচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের নাম টাইপ করলে ‘বেইলি রোড, ঢাকা’ নামটি দেখা যাচ্ছে সার্চ অপশনে। সেখানে ক্লিক করলে নতুন একটি পেজ চালু হচ্ছে। এবং সেখান থেকেই জানা গিয়েছে, স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা নেওয়ার জন্য বুকিং দেওয়া যাচ্ছে। প্রতিটি এলাকায় ‘আগে আসলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে ইন্টারনেট সেবা দিবে তারা। বুকিংয়ের জন্য জমা দিতে হবে ৯৯ ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮ হাজার ৬৫৯ টাকা। কোনো কারণে তারা সেবা দিতে ব্যর্থ হলে পুরো টাকা রিফান্ড করবে। নাম, ফোন নম্বর, ই-মেইল, ক্রেডিট কার্ডের তথ্য দিয়ে অর্ডার সম্পন্ন করতে হবে। পুরো অর্ডারের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে ১৫ মিনিটের মধ্যে। এভাবে প্রি বুকিং করতে হবে এরপর সরকারি অনুমোদন পাওয়ার পর সেবাটি চালু হয়ে যাবে। স্টারলিংক আশা করছে, ২০২৩ সালের মধ্যে তারা বাংলাদেশে সেবা চালু করতে পারবে। তবে বাংলাদেশের অনুমোদনেরও কিছু বিষয় আছে। সেক্ষেত্রে তারা যদি সেবা চালু করতে না পারে, তাহলে তারা ডিপোজিটের পুরো অর্থই গ্রাহককে ফেরত দিবেন বলে আশ্বাস দিয়েছে কোম্পানিটি।
এদিকে বাংলাদেশ সরকার ও বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়া স্টারলিংক তাদের ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার ঘোষণা কীভাবে দেয়, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, “সরকারের অনুমতি ছাড়া ইলন মাস্ক বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা চালু করতে পারেন না। স্যাটেলাইট দিয়ে আমার দেশে ইন্টারনেট সেবা দিতে পারবে কি না, এমন আবেদন আগে জমা দিতে হবে। তারপর দেশের সম্মতির ওপর নির্ভর করবে প্রি-বুকিং। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠান তাদের ক্ষেত্র অনুযায়ী সারা বিশ্বে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট দিতে পারলেও আমার দেশে দিতে পারবে কি না, সেটা দেখার ক্ষমতা আমার দেশের সরকারের।” তিনি আরও বলেন, “দেশে কেউ স্যাটেলাইট সেবা চালু করতে চাইলে সরকারের কাছ থেকে তাকে ল্যান্ডিং পারমিশন নিতে হবে। তারপর গ্রাহক পর্যায়ে সেবা দিতে গেলে বিটিআরসির অনুমোদন লাগবে।”
অন্যদিকে ভারতেও চালু হবে না এই ইন্টারনেট। ভারতে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছিলো স্টারলিংক এবং প্রি-বুকিং ও নেওয়া হচ্ছিলো। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে লাইসেন্স না পাওয়ায় প্রি অর্ডার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবং প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের প্রি-অর্ডারের টাকা ফেরত দিয়ে দেয়। এছাড়াও কিছুদিন আগে স্টারলিংক এর ভারতীয় ডিরেক্টর সঞ্জয় ভার্গভ স্টারলিংক প্রতিষ্ঠান থেকে তার পদত্যাগ করেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে কবে থেকে স্টারলিংক এর পরিষেবা চালু হবে ভারতে সে বিষয়ে এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে স্টারলিংক পরিষেবা নিয়ে সেভাবে কোনো কিছু আচঁ করা না গেলেও, ভারতে Airtel এবং Ji0, এই স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করবে বলে জানানো হয়েছে। কবে থেকে এই পরিষেবা চালু হবে সে বিষয়েও এখনো কিছুই জানানো হয়নি। এখন শুধু দেখার বিষয়, দুই দেশের অনুমোদন প্রক্রিয়ার ঝামেলা মিটে কবে থেকে স্টারলিংক ইন্টারনেট পরিষেবা পেতে শুরু করবে গ্রাহকরা!
শুরুর দিকে দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেট-সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করলেও ভবিষ্যতে সমগ্র বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবস্থায় স্টারলিংক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসতে চলেছে। স্টারলিংক এর মূল উদ্দেশ্য হলো গ্লোবাল কানেক্টিভিটি। একইসাথে হাইস্পিড, লো ল্যাটেন্সি, নেক্সট লেভেল ইন্টারনেট কানেকটিভিটি নিশ্চিত করাও এটির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। যার ফলে স্টারলিংক সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বর্তমানের অপটিক্যাল ফাইবার কানেক্টিভিটির সাথে এবং একসময় হয়তো এটিকে বিলুপ্তও করে ফেলবে। স্টারলিংক ব্যবহার করতে গেলে ছাদের উপর একটি ছোট এন্টেনা ছাড়া আর কোনোকিছুর প্রয়োজন পড়বে না। স্টারলিংকের ইন্টারনেট স্পিড হবে এখনকার ফোরজি’র প্রায় ১০ গুণ ও ফাইভ জি ইন্টারনেট স্পিড এর প্রায় সমান। স্টারলিংক এর প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক জানান, “শুরুর দিকে স্কাইনেটের ল্যাটেন্সি হবে ৩০-৩৫ মিলিসেকেন্ডের আশেপাশে, এবং পরবর্তীতে সেটা ১০ মিলিসেকেন্ড কিংবা তারও নিচে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।”
স্টারলিংক ইন্টারনেট ভবিষ্যতের ইন্টারনেট প্রযুক্তিতে আধিপত্য বিস্তার করবে, এ আর বুঝতে বাকি নেই। টেলিকমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা থেকে ইলন মাস্ক প্রতিবছর প্রায় ৩০ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার অর্থ উপার্জন করতে পারবে। অর্থাৎ স্টারলিংক প্রজেক্ট সফল হলে এটি তাদের অভিভাবক সংস্থা স্পেসএক্সের চেয়েও বেশি লাভজনক হবে।
এই ছিলো স্টারলিংক ইন্টারনেট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। যেকোনো প্রশ্ন জাগলে নির্দ্বিধায় কমেন্টবক্সে কমেন্ট করুন। এবং টেকনোলজি সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। সেইসাথে আমাদের অন্যান্য আর্টিকেলগুলোও পড়তে পারেন। ধন্যবাদ।