বর্তমানে আমরা কোথাও না কোথাও NFTs শব্দটি শুনেছি। এর বিস্তারিত সম্পর্কে না জানলেও, এই শব্দটি আজকাল অনলাইন জগতে প্রচুর পরিচিত। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম সহ বিভিন্ন সোশ্যাল সাইটে বর্তমানে ভাইরাল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে NFTs শব্দটি। আজকে তাহলে আলোচনা করা যাক NFTs সম্পর্কে।
NFTs কি
NFTs এর পূর্ণরূপ হলো, Non-Fungible Tokens। বোঝার সুবিধার্থে এটিকে আমরা ২ ভাগে ভাগ করে নিলাম, Non-Fungible ও Tokens। প্রথমে Non-Fungible বিশ্লেষণ করি। Non-Fungible এর বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, যার মধ্যে ছত্রাক জন্মাবে না। তবে এটির প্রকৃত অর্থ হলো, অপরিবর্তনীয়। ধরা যাক, আমি বাজারে গিয়ে দোকান থেকে ৯০ টাকার বাজার করেছি এরপর দোকানদারকে ১০০ টাকার নোট দিয়েছি। এখন উনি আমাকে ১০ টাকা ফেরত দিবেন। উনি চাইলে আমাকে দুইটা ৫ টাকার নোট ফেরত দিতে পারেন আবার চাইলে ১০ টাকার নোট ও দিতে পারেন। কারণ ১০ টাকার একটি নোট ও দুইটি ৫ টাকার নোটের মান একই সমান। এইযে ব্যাপারটি দুইভাবেই একইরকম, সুতরাং এটি হলো Fungible। এখানে টাকার মান দুইভাবে পরিবর্তন করা যাচ্ছে। অন্যদিকে, Non fungible-এ এরকম পরিবর্তন করা যাবে না। Non fungible এর অর্থ এমন একটি ডিজিটাল সম্পদ যা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। যেমন ধরা যাক, মোনালিসার চিত্র। মোনালিসার চিত্র অনুকরণ করে আরেকটি আকা যেতে পারে কিন্তু এর মূল চিত্রটির মান একই থাকবে। উদাহরণ হিসেবে আমরা বাহ্যিক পৃথিবীর আরও কিছু বলতে পারি, যেমন অ্যামেরিকার ভাস্কর্য Statue of Liberty কিংবা চায়নার Great wall অথবা ইন্ডিয়ার Howrah Bridge। উপরের কোনোটিরই পরিবর্তন সম্ভব নয়, যদিও অনুকরণ করা হয় তাহলে মূলটির মান, নাম একই থাকবে। আমরা জানি, পৃথিবীতে যেকোনো ভাস্কর্যই অপরিবর্তনীয়, তবে সেটিরও নকল করা যায়। কিন্তু NFTs এর কাজ হলো এমন ধরনের শিল্পকে টোকেনাইজড (Tokenized) করে মালিকানার ডিজিটাল সার্টিফিকেট তৈরি করা যার সাহায্যে আসল জিনিসটি কেনা ও বেচা যাবে। এবং সেটিকে Cryptocurrency দিয়ে ক্রয় করতে হয়। Cryptocurrency এর সাহায্যে ক্রেতার পরিচয় ও কী কেনা হলো তার একটা রেকর্ড Blockchain – এ থেকে যায়। এই রেকর্ড কোনোভাবেই বদলে ফেলা সম্ভব নয়। কারণ এটা বিশ্বের বহু কম্পিউটারের মাধ্যমে হয়। তাই কোনও না কোনও জায়গায় এর প্রমাণ থেকেই যায় বা যাবে। Token এর বৈশিষ্ট্য হলো যতবারই টোকেন বিক্রি হবে ততবারই টাকার অঙ্ক বৃদ্ধি পাবে। যে কেও নিজের কাজকে NFTs এর সাহায্যে টোকেইনাইজ করে নিতে পারবে। অনেকে কয়েক কোটি ডলার ইনকামও করেছেন। টুইটারের সহপ্রতিষ্ঠাতা Jack Dorsey তাঁর প্রথম Tweet NFTs হিসেবে বিক্রি করেন। যা ২.৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করা হয়। সঙ্গীতশিল্পী গ্রাইমস (Grimes) নিজের কিছু ডিজিটাল আর্ট বিক্রি করেন ছয় মিলিয়ন ডলারে। Animated Gif নিয়ান ক্যাট (Nyan Cat) বিক্রি করা হয়েছে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডলারে।
NFTs এর উদাহরণ
NFTs একটি নতুন বিষয় হওয়ায় আমরা অনেকে এর সাথে পরিচিত নই। বর্তমান সময়ের যেসব ডিজিটাল অ্যাসেট NFTs হিসেবে বিক্রি হচ্ছে, সেগুলো হলো :- আর্ট, GIF, ভিডিও, অডিও, পিকচার, কালেক্টিবলস, ভার্চুয়াল এভাটার, ভিডিও গেম স্ক্রিন, স্পোর্টস হাইলাইট ডিজাইনার স্নিকারস এছাড়াও আরো অনেককিছু রয়েছে। মোদ্দাকথা, নিজের তৈরী যেকোনো ইউনিক কন্টেন্ট ই NFTs হিসেবে বিক্রি করা যাবে।
Blockchain ও NFTs এর যোগসূত্র
২০১৫ সালে NFTs এর শুরু হয়। তবে সম্প্রতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে এসেছে NFTs। এর পেছনে মূল কারণ হলো, Cryptocurrency ও Blockchain প্রযুক্তি। এক্সক্লুসিভ সব ডিজিটাল কনটেন্ট কিনতে কিংবা ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে জমা করতে ব্যাপক হারে NFTs কিনছেন ক্রেতারা। যখন কেও একটি NFTs কিনেন, তখন উক্ত কনটেন্ট ইন্টারনেটে থাকলেও এর ডিজিটাল মালিকানা থাকে ক্রয়কারীর কাছে। একটি NFTs ইন্টারনেটে যত বেশি জনপ্রিয়তা পায়, এর দামও ততো বাড়তে থাকে। যখন কোনো NFTs বিক্রি হয়, তখন উক্ত NFTs এর আসল ক্রিয়েটর কিছু % প্রফিট পেয়ে থাকেন। আবার যে প্ল্যাটফর্মে কেনা-বেচা হচ্ছে, সে প্ল্যাটফর্ম নির্দিষ্ট একটি চার্জ পেয়ে থাকেন। বাকি থাকা রেভিনিউ, উক্ত NFTs ক্রয়কৃত বর্তমান মালিক এর কাছে যায়। বলা যায়, এভাবে ডিজিটাল অ্যাসেট কেনা-বেচার মাধ্যমে একটি নতুন ইকোনমিক তৈরী হচ্ছে। NFTs এর মূল বিষয় হচ্ছে Authenticity বা কোনো অ্যাসেট এর সত্যতা। ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে একটি NFTs তথ্য ধারণ করে যা অন্য NFTs থেকে আলাদা করা ও ভেরিফাই করতে সহজ হয়। নকল তৈরী করে কেনা-বেচা করার চেষ্টায় কোনো লাভ নেই, কেননা ব্লকচেইন প্রযুক্তির সাহায্যে আসল মালিককে ধরা করা যায় খুব সহজে।
NFTs ক্রয়
এতকিছু জানার পর অবশ্যই আপনাদের প্রশ্ন জেগেছে, NFTs কিভাবে ক্রয় করা যেতে পারবেন। এবার তাহলে এ বিষয়ে আলোচনা করা যাক, NFTs ও cryptocurrency জমা করতে প্রথমেই আমাদের ডিজিটাল wallet লাগবে। NFTs provider কি ধরনের cryptocurrency নিচ্ছে তা খেয়ালে রেখে কারেন্সি ক্রয় করতে হবে। Cryptocurrency ক্রয় করতে ওপেনসি (opensea), কয়েনবেস (coinbase), পেপাল (paypal) ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারেন। এরপর NFTs কেনার জন্য আপনার ওয়ালেট তৈরী করে আপনার পছন্দমতো NFTs কিনে ডিজিটাল ওয়ালেটে জমা করবেন। এবার কিছু NFTs মার্কেটপ্লেস সম্পর্কে বলি। OpenSea মার্কেটপ্লেস NFTs কেনা-বেচা করার জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ওয়েবসাইট। Rarible একটি পাবলিক NFTs মার্কেটপ্লেস যেখানে আর্টিস্ট ও ক্রিয়েটরগণ NFTs বিক্রি করে থাকেন।
NFTs কি পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য
NFTs সম্পর্কে অনেক বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এর ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি NFTs দিয়ে যিনি রেকর্ড আয় করেছেন Mike Winkelmann তিনি বলেছেন, “সত্যি বলতে গেলে এই পুরো বিষয় নিয়ে আমার মনে সন্দেহ রয়েছে, এটা প্রতারণাও হতে পারে।” Charles Allsopp বলছেন, “NFTs কেনার সিদ্ধান্তের কোনও মানে নেই”। তাঁর মতে যেটা চোখে দেখা যায় না সেটা কেনার মধ্যে কোনও যুক্তি নেই। এ পর্যন্ত যতগুলো NFTs বিক্রি হয়েছে, লক্ষ্য করলে দেখবেন তারা কোনো সেলিব্রিটি আর না হয় NFTs বিষয়টি অতিরিক্ত ভাইরাল বিষয় হওয়ার কারণে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমাদের না আছে পপুলারিটি না আছে ফ্যান ফলোয়ার! বিক্রির ক্ষেত্রে মিলিয়ন ডলার তো দূর হাজারের ঘরে থাকতে পারবো কি না এবিষয়ে সন্দেহ রয়েছেই। তবে হ্যা, যদি একান্তই আমরা কেও বিরল কোনো অ্যাসেট তৈরী করতে পারি, এবং সেটি যদি লোকনজরে আসে তবে অবশ্যই মিলিয়ন ডলার ইনকাম করা সম্ভব। অন্যদিকে আরও একটি বিষয় থেকেই যায় সেটি হলো, একটি NFTs asset কতটা বিরল হবে বা থাকবে এবিষয়েও প্রশ্ন জাগায়। তাই NFTs নিয়ে খুব বেশি সময় নষ্ট না করাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যেহেতু সাধারণ মানুষের সফলতার গল্প এখনো আমরা দেখতে পাই নি। আপনাদের হয়ত মনে হতে পারে আমি আপনাদের NFTs বিষয়ে নিরুৎসাহিত করছি, তাহলে আপনারা ভুল ভাবছেন। আমি NFTs এর বাস্তবতা তুলে ধরছি। আপনাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর নির্ভর করে আপনারা NFTs বিষয়টির উপর কি সিদ্ধান্ত নিবেন।
এইছিলো NFTs সম্পর্কে আজকের বিস্তারিত সব আলোচনা। আশা করি আপনারা সবাই বুঝতে পেরেছেন। টেকনোলজি সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। সেইসাথে আমাদের অন্যান্য আর্টিকেলগুলোও পড়তে পারেন। ধন্যবাদ।