আমরা এমন পৃথিবীর সাথে পরিচিত যেখানে মিটার, কিলোমিটার ইত্যাদি পরিমাপের সাথে অভ্যস্ত। কিন্তু যা চোখে দেখা সম্ভব নয় কিংবা অতি ক্ষুদ্র সেগুলোর পরিমাপের সাথে আমরা এখনো তেমন পরিচিত নই। ক্ষুদ্র বস্তু পরিমাপের জন্য আবিষ্কার হয়েছে ন্যানো শব্দটি। ন্যানো টেকনোলজি (Nano technology) বর্তমান বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সবচেয়ে আশ্চর্যকর নিদর্শন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যত প্রযুক্তি রয়েছে সব প্রযুক্তিতে কোন না কোন বিষয়ে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ বর্তমানে আমরা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর আবিষ্কারকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি।
পরমানবিক ও আণবিক স্কেলে অতিক্ষুদ্র ডিভাইস তৈরী করার জন্য ধাতব বস্তুকে সুনিপুণভাবে কাজে লাগানোর বিজ্ঞানকে ন্যানো টেকনোলজি বলে। ন্যানো টেকনোলজিকে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে যেমন ন্যানো প্রযুক্তি, ন্যানোটেক (Nano Tech)। এটি মূলত একটি আণবিক স্কেল দ্বারা পরিচালিত হয়। আর এর সাহায্যে বিজ্ঞান, যন্ত্র বিদ্যা এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে জানা যায়। ন্যানো শব্দটি গ্রীক Nanos থেকে এসেছে যার আভিধানিক অর্থ Dwarf (বামন বা জাদুকরী ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষুদ্রাকৃতির প্রাণী)। ন্যানো টেকনোলজি শব্দের ন্যানো অর্থ হলো ছোট বা ক্ষুদ্র। কোন ধূলিকণার এক লাখের এক ভাগকে মূলত ন্যানো বলা হয়। এই ছোট বস্তুর সাহায্যে তৈরি প্রযুক্তির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ন্যানো টেকনোলজি আবিষ্কার হয়। ন্যানাে প্রযুক্তির সাহায্যে ন্যানােমিটার স্কেলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুর উপাদান দিয়ে কাক্ষিত কোন বস্তু তৈরি করা যায়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে অণু-পরমাণুকে ভাঙ্গিয়ে বা জোড়া লাগিয়ে আগামী দিনে অনেক কিছু করা সম্ভব। ন্যানাে টেকনােলজির ক্ষেত্রে দুটি প্রক্রিয়া আছে। একটি হল উপর থেকে নিচে (Top to Bottom) ও অপরটি হল নিচ থেকে উপরে (Bottom to top)। টপ টু ডাউন পদ্ধতিতে কোন জিনিসকে কেটে ছােট করে তাকে নির্দিষ্ট আকার দেয়া হয়। আর বটম টু টপ হল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারের ছােট জিনিস দিয়ে বড় কোন জিনিস তৈরি করা। আমাদের বর্তমান প্রযুক্তিগুলো হলো টপ টু ডাউন প্রযুক্তি।
২০১১ এর মার্চে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, “প্রায় ১৩০০ আইটেমে ন্যানাে টেকনােলজির ব্যবহার রয়েছে।” দিন দিন এর ব্যবহার বাড়ছে। যেমন, আমাদের কম্পিউটারের প্রসেসরের ভেতরে রয়েছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ন্যানােমিটার স্কেলের সার্কিট। আর তাতে ব্যবহৃত হয়েছে ন্যানাে টেকনােলজি। ইন্টেল প্রসেসরে সিলিকন এর উপর প্যাটার্ন করে সার্কিট বানানো হয় যার বর্তমান সাইজ হলো ৩০ ন্যানােমিটার। ভবিষ্যতে আরাে ছােট আকারে নিয়ে আসলে প্রসেসর এর আকার অনেক ছােট হয়ে যাবে। এক মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ হলাে এক ন্যানােমিটার। ন্যানাে টেকনােলজি হলাে বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি, যা পরিচালিত হয় ন্যানাে স্কেলে এবং এটি ১ থেকে ১০০ ন্যানাে মিটার হয়ে থাকে। যেমন, যদি একটি বল এক ন্যানােমিটার হয় তাহলে পৃথিবীর সাইজ হবে এক মিটার। আবার অন্যদিকে একটি ছবি জুম করতে করতে পরিশেষে শুধু চারকোনা ইটের দেওয়ালের মতো দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রত্যেকটি চারকোনা ব্লক গুলোকে এক একটি পিক্সেল বলা হয়, যেটি ছবির বর্ণনা ধারণ করে এবং একত্রে সকল পিক্সেল গুলো মিলে একটি সম্পূর্ণ ছবি তৈরি করে। একটি চারকোনা ইটের ব্লক ঐ ছবিটির জন্য ন্যানো পিক্সেল। ন্যানােসায়েন্স এবং ন্যানাে টেকনােলজি হলাে একক অণু-পরমাণু দেখা এবং নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য। ন্যানাে প্রযুক্তির ফলে কোন উপকরণকে এতটাই ক্ষুদ্র করে তৈরি করা যায় যে, এর থেকে আর ক্ষুদ্র তৈরী করা সম্ভব নয়। এই পৃথিবীর যা কিছু আমরা খাই, যা আমরা পরি, ঘরবাড়ি, আমাদের দেহের সব কিছু পরমাণু দিয়ে গঠিত। কিন্তু পরমাণু এতাে ছােট যে খালি চোখে তা দেখা যায় না।
আমেরিকার পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান ন্যানো টেকনোলজির জনক। ১৯৫৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরে তিনি সর্বপ্রথম এক আলোচনা সভায় ন্যানো টেকনোলজি সম্পর্কে বলেন। এরপর থেকে ন্যানো প্রযুক্তি সম্পর্কে বিভিন্নভাবে আলোচনা ও গবেষণা হতে থাকে। ১৯৮০ সালে IBM এর গবেষকরা প্রথম আবিষ্কার করেন STM (Scanning Tunneling Microscope) এই যন্ত্রটি। এটি দিয়ে অণুর গঠন পর্যন্ত দেখা সম্ভব। এই যন্ত্রটির আবিষ্কার ই ন্যানাে প্রযুক্তিকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে।
ন্যানো টেকনোলজির অনেক সুবিধা ভবিষ্যতের কয়েক দশকের মধ্যে দেখতে পাওয়া যাবে কিন্তু বর্তমানেও এই প্রযুক্তি নানান ভাবে আমাদের পৃথিবীকে পরিবর্তিত করতে সাহায্য করছে। ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারে চিকিৎসাবিজ্ঞান, ইলেকট্রনিক্স, শক্তি উৎপাদনসহ বহু ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যেমন ন্যানো টেকনোলজিতে তৈরি কাপড়ের তন্তু এতোটাই সূক্ষ্ম যে এতে ধুলি বালু কণা আটকে থাকতে পারে না, ফলে কাপড় অনেক কম নোংরা হয়। কিছু ব্র্যান্ডের সানস্ক্রীন ক্রিমে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়, এতে ক্রিমটি স্কিনে লাগানোর সাথে সাথে টাইটানিয়াম অক্সাইড অথবা জিঙ্ক অক্সাইডের আস্তরণ ফেলে দেয়, ফলে সূর্যের ক্ষতিকর আলট্রা ভায়োলেট রশ্মিকে স্কিনে লাগতে দেয় না। ন্যানো টেকনোলজিতে তৈরি অনেক পেইন্টও এভাবেই কাজ করে, ফলে এটি অধিক দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং কম ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। বর্তমানের কম্পিউটার প্রসেসর ১০০-২০০ ন্যানো মিটারের ট্র্যানজিস্টর দ্বারা প্রস্তুত হয়ে থাকে এবং দিনদিন এর সাইজ আরো কমানো হচ্ছে আর এই সবই সম্ভব হচ্ছে ন্যানো টেকনোলজির ফলে। কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা উদ্ভবন করেন যে, একই জায়গার মধ্যে বেশি ট্র্যানজিস্টর আটাতে পারলে কম্পিউটারের সাইজ আরো ছোট এবং বেশি পাওয়ারফুল বানানো সম্ভব হবে। শুধু কম্পিউটার প্রসেসর নয়, হার্ডডিস্ক এর মেমোরি পরিসর বাড়ানো এবং হার্ডডিস্ক এর আকার ছোট করার কাজে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফ্ল্যাট স্ক্রীন এচডি টিভি, স্মার্টফোন, আইপড ইত্যাদি সব গুলোতেই ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে চিপ লাগানো থাকে। ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে অতি ক্ষুদ্র রোবট তৈরির গবেষণা চলছে। মহাকাশ অভিযানে ব্যবহৃত বিভিন্ন নভোযানকে ন্যানো প্রযুক্তি এর মাধ্যমে হালকা করে তৈরি করে জ্বালানির পরিমাণ কমানো হচ্ছে। বিদ্যুৎ খরচ, ওজন এবং আকৃতি কমিয়ে কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি তৈরিতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। ন্যানোসেন্সর ব্যবহার করে মানবদেহের রক্তের ভেতরে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান বায়োমার্কার সম্পূর্ণভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। এবং ন্যানো সূঁচ ব্যবহার করে সূক্ষ্মভাবে শুধুমাত্র ক্যান্সার আক্রান্ত কোষে ঔষধ প্রয়োগ করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা যাবে বলে গবেষণা চলছে। এছাড়াও ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনুভূতিসম্পন্ন কৃত্রিম অঙ্গ প্রত্যক্ষ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। ন্যানো টেকনোলজি এর মাধ্যমে শিল্প কারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকারক ধোঁয়াকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে অক্ষতিকর গ্যাসে রূপান্তরের মাধ্যমে বাতাসে পরিশোধন করা যাবে। এবং ন্যানো টেকনোলজি এর মাধ্যমে আকারে ছোট, টেকসই মজবুত এবং উন্নত মানের পণ্য তৈরি করা যাবে, যা অন্য কোন প্রযুক্তি তৈরি করতে পারে নি।
ন্যানো টেকনোলজি এর প্রয়োগ ক্ষেত্র
বিভিন্ন ক্ষেত্রে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং হবে। সেগুলো হলো :-
১. ন্যানো রোবট তৈরিতে
২. ঔষধ তৈরিতে
৩. কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরিতে
৪.বাতাস পরিশোধনে
৫. ক্যান্সার রোগ নির্ণয় ও নিরাময়
৬. কম্পিউটার হার্ডওয়্যার তৈরিতে
৭. ইলেকট্রনিক্স শিল্পে
৮. রাসায়নিক শিল্পে
৯. মহাকাশ অভিযানে
ন্যানো টেকনোলজি এর ক্ষতিকারক দিক
ন্যানো টেকনোলজি তে সুবিধা থেকে অসুবিধা কিংবা ক্ষতিকর দিকের পরিমাণ খুবই কম। এতে অল্প কিছু অসুবিধা রয়েছে তবে মানুষ সমাধান করতে পারলে ব্যাপক পরিমাণের সুবিধা ভোগ করতে পারবে। সেই সাথে লক্ষ্যণীয় এ প্রযুক্তির ভুল ব্যবহার বিরাট ক্ষতি করতে পারে। ন্যানো প্রযুক্তির কয়েকটি ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরা হলো :-
- ন্যানো টেকনোলজি গবেষণা এবং প্রয়োগ অনেক ব্যয়সাপেক্ষ যে কারণে মানুষের খরচের পরিমাণ আরো বেশি বাড়িয়ে দিবে।
- ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে মারাত্মক যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করা সম্ভব বিধায় যুদ্ধক্ষেত্রে আরো ভয়াবহতার আশংকা রয়েছে।
- ন্যানো টেকনোলজির ন্যানো প্রোডাক্ট অত্যন্ত ছোট হয়ে থাকে। এটা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে মানুষের শরীরের বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিসাধন করতে পারে। অনেক ন্যানো প্রোডাক্টস মানুষের মস্তিষ্ক এবং ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
- ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহারের ফলে পানি এবং বায়ু দূষণ হতে পারে যা মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণিদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
- ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে মাইক্রোস্কোপিক রেকর্ডিং ডিভাইস তৈরি করা যাবে যা সাধারণ চোখে দেখা যাবে না। এতে করে মানুষের প্রাইভেসি এবং সিকিউরিটি নিয়ে আশঙ্কা রায়েছে।
ইলেকট্রনিক, খাদ্য সংরক্ষণ, চিকিৎসা বিজ্ঞান, রাসায়নিক প্লান্ট, অটোমোবাইল ইত্যাদি ক্ষেত্রে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার দিনদিন বেড়েই চলেছে। আগামী যুগ যে ন্যানো প্রযুক্তির যুগ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ন্যানো টেকনোলজি ভবিষ্যৎ -এ সারাবিশ্ব রাজ করবে। এই ছিলো ন্যানো টেকনোলজি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। যেকোনো প্রশ্ন জাগলে নির্দ্বিধায় কমেন্টবক্সে কমেন্ট করুন। এবং টেকনোলজি সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। সেইসাথে আমাদের অন্যান্য আর্টিকেলগুলোও পড়তে পারেন। ধন্যবাদ।