আমাদের ব্রেইনে বসবে মেমোরি কার্ড। শুনতে অবাক লাগলেও, এটাই সত্যি হতে চলেছে। কারণ ইতিমধ্যেই এই উদ্যোগ সম্পর্কে জানিয়েছেন মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক (Elon Musk)। ইলন মাস্ক নামটি ব্যবসা ও প্রযুক্তির জগতে অতি পরিচিত একটি নাম। আমাদের সবার কাছে পৃথিবীর সকল সফল উদ্যোক্তার জীবনীর মাঝে ইলন মাস্ক নামটি যেন সেরা উদাহরণ। পৃথিবীতে উদ্যোক্তা ধারণার মাধ্যমে অনেকেই উন্নতির চূড়ায় আরোহন করেছেন এবং হয়েছেন পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা ধনী ব্যক্তিগণ। যেমন- মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, ফেসবুকের CEO মার্ক জুকারবার্গ, আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস, LVMH এর CEO বার্নার্ড আর্নল্টের, গুগলের CEO ল্যারি পেজ সহ আরো অনেকেই। তবে তাদের কর্মে রয়েছে সীমাবদ্ধতা। তারা নির্দিষ্ট একটা বিষয় নিয়ে কাজ করেন। এদিক থেকে তাদেরকে ছাড়িয়ে গেছেন ইলন মাস্ক। আজকের ব্লগের মূল বিষয় শুরু করার আগে ইলন মাস্ক সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা যাক।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের প্রথম ধনী ব্যক্তি হলেন ইলন মাস্ক। তিনি একজন দক্ষিণ আফ্রিকান প্রকৌশলী ও প্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা। ইলন মাস্ক মহাকাশ ভ্রমণ সংস্থা স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা, বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টেসলা মোটরসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও পণ্য প্রকৌশলী, সোলারসিটির চেয়ারম্যান, দি বোরিং কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা, ওপেনএআইয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান এবং পেপ্যালের একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়াও তিনি হাইপারলুপ নামক কল্পিত উচ্চ গতিসম্পন্ন পরিবহন ব্যবস্থার উদ্ভাবক। এবং তার সবচেয়ে মূল পরিচয় আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ের জন্য সেটি হলো, তিনি নিউরালিংকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
মস্তিষ্কের সাথে কম্পিউটার সংযুক্ত করবে ইলন মাস্কের নিউরালিংক। গতবছর এমনটাই জানিয়েছেন ইলন মাস্ক Worldstreat journal কে। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত নিউরালিংক প্রতিষ্ঠানটি এতদিন খুব একটা পরিচিত ছিলো না। তবে সম্প্রতি নিউরালিংক তাদের “নিউরালিংক” যন্ত্র অর্থাৎ ব্রেইনচিপের ঘোষণার পর থেকে প্রযুক্তি বিশ্ব নেড়েচেড়ে উঠেছে। নিউরালিংক প্রতিষ্ঠান মূলত কাজ করছে পক্ষাঘাত (Paralyzed) রোগীদের জন্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিওরালিংকের সাহায্যে প্যারালাইজড রোগীদের জন্য এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। ব্রেইনের সাথে অতি সুক্ষ্ম তার দিয়ে একটি বিশেষ ডিভাইস যুক্ত থাকবে রোগীর ঠিক কানের পেছনে। যার আকৃতি হবে তারবিহীন ছোট ইয়ারফোনের মতো। এই ডিভাইসটি কম্পিউটার, স্মার্টফোন অথবা অন্য যেকোনো যন্ত্রের সাথে সংযুক্ত থাকবে আর এর ফলে যে কেও হাত পা এর সাহায্য ছাড়া শুধুমাত্র চিন্তাশক্তি দিয়ে তা নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। এমনটি যদি সত্যি ই মানুষের ক্ষেত্রে করা সম্ভব হয়, তাহলে পৃথিবীকে কতটা বদলে দিবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এবার প্রশ্ন জাগতেই পারে, ডিভাইস মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত করার পর কোনো সমস্যা হবে কি না? এ নিয়ে ইলন মাস্ক বলেছেন, “মানব মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত ডিভাইসটি এতই সুক্ষ্ম তারের মাধ্যমে লাগানো হবে, যা অনেকটা চুলের মতোই পুরু। কারো কোনো সমস্যা হবেনা বললেই চলে। তবে ডিভাইসটি আরো উন্নত করার প্রক্রিয়া এখনো অব্যহত আছে।” প্রতিষ্ঠানটি এও দাবী করেছে, “ব্রেইনচিপটি স্থাপন ও অপসারণ সম্পূর্ণ নিরাপদ।” ইতিমধ্যে বানর ও শূকরের মস্তিষ্কের মধ্যে সফলতার সাথে ব্রেইচিপটি স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি গতবছরের এপ্রিল মাসে, পেজার (Pager) নামের একটি বানরের ভিডিও প্রকাশ করে। যেখানে দেখা যায়, কোনোরকমের স্পর্শ ছাড়াই শুধুমাত্র মস্তিষ্ক ব্যবহার করে পেজার বানরটি কম্পিউটারে পিংপং গেম খেলছে।
চিপের প্রথম সংস্করণ সকলের সামনে উন্মোচন করার আগেই এর দ্বিতীয় সংস্করণের কথা ভেবে রেখেছেন ইলন মাস্ক। তিনি বলেছেন, “আমাদের পরবর্তী সংস্করণে এই ডিভাইসটি হবে তারবিহীন। তখন কেবল মস্তিষ্কের সাথে মাথার ভেতরই একটি চিপ সেট করা থাকবে। বাইরে থেকে যা বোঝা যাবেনা। এটির সাথে ব্লুটুথ বা ওয়াইফাই কানেক্টেড যেকোনো ডিভাইস দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে।” শুধু যে ব্রেইনচিপ আবিষ্কারের কাজ চলছে প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যপারটি তা নয়, এই চিপ কিভাবে অপারেশন ছাড়াই কোনো ব্যক্তির মাথায় সঠিকভাবে সেট করা যাবে তার জন্যও একটি বিশেষ ধরনের রোবট তৈরি করছে নিউরালিংক প্রতিষ্ঠান।
নিউরালিংক প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হচ্ছে স্নায়ুবিক সমস্যা আছে, এমন ব্যক্তিদের মাথায় ওয়্যারলেস ব্রেইনচিপ বসিয়ে আলঝেইমার, ডিমেনশিয়া কিংবা মেরুদণ্ডে সমস্যা ইত্যাদির সমাধান করবে। সহজ কথায়, মানুষের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংযোগ করে দিয়ে স্নায়ুবিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা হবে। সেই সঙ্গে শুধু চিন্তাশক্তি দিয়ে স্মার্টফোন থেকে স্মার্ট কার পর্যন্ত সবকিছু চালানোর ব্যবস্থা করা হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে মানুষ যাতে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ে সেই চিন্তাও এই নিউরালিংক প্রজেক্টের পেছনে কাজ করছে। এই ব্রেইনচিপ সম্পর্কে যতই জানা হচ্ছে ততই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। দেখাই যাক শেষটা কি হয়! তবে প্রকল্পটির পেছনের মানুষটা যেহেতু ইলন মাস্ক, শেষ না দেখে যে তিনি ছাড়বেন না, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। ইলন মাস্ক শুধু বলেনই না, তিনি করেও দেখান।
এবার নিউরালিংক প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক। ইলন মাস্ক তার এক বক্তব্যে বলেছেন, “জিনিসটি ছোট ছোট তার দিয়ে খুলিতে বসানো ফিটবিটের মতো।” ফিটবিট অর্থ, বর্তমানে স্মার্টফোনে বসানো চিপ যেটি দিয়ে হৃৎস্পন্দন অথবা রক্তচাপের রেকর্ড করা হয়। নিউরালিংক ১ হাজার ২৪ টি চ্যানেল বা ইলেকট্রোডযুক্ত ২৩×৮ মিলিমিটার আকৃতির একটি চিপ। ইলেকট্রোডগুলো নন-করোসিভ, ক্ষয়ে যাবে না এমন পদার্থ দিয়ে তৈরি (যেমন সিলিকন কার্বাইড)। ব্যাস ৫ মাইক্রন। এই ব্যাসের পরিমাপ মানুষের একটি চুলের ২০ ভাগের ১ ভাগ। নিউরালিংক নিউরন থেকে আসা সিগন্যাল ‘রিড’ অর্থাৎ শনাক্ত করতে পারবে এবং সে হিসেবে ‘রাইট’ অর্থাৎ নিউরনকে নির্দিষ্ট কোনো কাজের কথা ভাবার জন্য যে বৈদ্যুতিক ইমপালস তৈরি করতে হয়, সেটি উৎপন্ন করবে। ফলে নিউরনটি সক্রিয় হবে এবং সেই কাজ করতে পারবে।
মস্তিষ্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব এমন ধারণা প্রথম সামনে এনেছিলেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা (Nikola Tesla)। কিন্তু বেশ কিছু জটিলতায় তিনি তার জীবদ্দশায় সেটি সম্পন্ন করতে পারেননি। তাই কিছু প্রবীণ বিজ্ঞানী মনে করছেন, তার অসম্পূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করছে নিউরালিংক। তবে ইলন মাস্কের সাক্ষাৎ -এর বক্তব্য বলছে ভিন্ন কথা। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো তার এই ধারণাটির জন্ম নিয়েছিলো একটি উপন্যাসের সিরিজ থেকে। ইলন মাস্কের সাক্ষাৎ নেয়া Wait & Why জানায়, “লেইন ব্যাংকস (Lain Banks) এর ১০ম খন্ডের উপন্যাস The Culture এর নেচারাল লেস খন্ড থেকে ইলন মাস্ক অনুপ্রাণিত হয়েছেন।”
আবারও বলছি, এটি যদি মানুষের ক্ষেত্রে সত্যিই করা সম্ভব হয় তাহলে পৃথিবীর কি পরিমাণ পরিবর্তন হবে তা শুধু অদূর ভবিষ্যতের পৃথিবী ই জানে। আর এই কারণেই ইলন মাস্ক আর নিউরালিংক নিয়ে এত আলোচনা। বর্তমানে যে এরকম ব্রেইন মেশিন ইন্টারফেস নেই কিংবা অন্য কোম্পানি এটা নিয়ে গবেষণা করেনি এমনটি কিন্তু নয়। তবে তাদের এই গবেষণার সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হচ্ছে তারা ব্রেইনের ভিতরে ঢুকানোর জন্য যে সূতার ন্যায় বস্তু তৈরী করেছে তা এতই সূক্ষ্ম যে মানুষের ব্রেইনের কোন ক্ষতি করবে না। তাই অন্যান্য ব্রেইন মেশিন ইন্টারফেসের চেয়ে নিউরালিংক এগিয়ে আছে। নিউরালিংকের এই প্রযুক্তি মানুষকে প্রযুক্তি জগৎ এর নতুন এক যুগে প্রবেশ করাবে। কল্পবিজ্ঞানের বিচিত্র জগৎ ছেড়ে চিন্তার মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করার ব্যাপারটি হয়ে যাবে বাস্তব। পেজারের ভিডিওটিও ইঙ্গিত দিচ্ছে, এটা সম্ভব। বলে রাখা ভালো, ইলন মাস্ক কিন্তু এখানেই থামতে রাজি নন। গত বছরের নিউরালিংক ইভেন্টে তিনি আরও বলেছেন, “ভবিষ্যতে নিউরালিংক স্মৃতি “সেভ” (save) করে রাখতে পারবে এবং সময়মতো “রিপ্লে” (replay) দেখাতে পারবে। তিনি মনে করেন, চাইলে স্মৃতির “ব্যাকআপ”(backup) রেখে দেওয়া যাবে এবং পরে “রিস্টোর”(restore) করে নেওয়া সম্ভব।” তাঁর ভাষ্যমতে, “আমরা চাইলে এসব স্মৃতি নতুন কোনো দেহে বা কোনো রোবটের ভেতরে ডাউনলোড করে নিতে পারবো।” বড়ই বিচিত্র এক ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছি আমরা! দেখা যাক আমাদের জন্য কি কি নতুন প্রযুক্তি অপেক্ষায় রয়েছে!
ব্রেইনচিপ নিয়ে এইছিলো অবিশ্বাস্য সব তথ্য। যেকোনো প্রশ্ন জাগলে নির্দ্বিধায় কমেন্টবক্সে কমেন্ট করুন। এবং টেকনোলজি সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। সেইসাথে আমাদের অন্যান্য আর্টিকেলগুলোও পড়তে পারেন। ধন্যবাদ