বর্তমানে আমরা যেসব যন্ত্র ব্যবহার করি সেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানাভাবে সাহায্য করে জীবনকে করে তুলেছে আরও সহজ এবং আধুনিক। কয়েক দশক পেছনে তাকালেই দেখা যায়, কত কঠিন পরিস্থিতি ছিলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন অনেককিছুই সহজ হয়ে গিয়েছে। বলা বাহুল্য, প্রযুক্তি উন্নয়নের শেষ নেই। তাই তো বর্তমানে বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, দৈনন্দিন জীবনে যাতে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলো নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে পারে এই বিষয়টি নিয়ে। বিষয়টি সত্যি ই প্রয়োজনীয়, একটু ভাবলেই বোঝা যায় এমন যদি হয় তাহলে অনেক সহজ হয়ে যাবে আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবন! এজন্য বর্তমান দুনিয়া স্মার্ট ডিভাইসের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে আছে এবং এই জাদুর মূল বিষয় হলো IOT।
আইওটি (IOT) এর পূর্ণরূপ হলো ইন্টারনেট অফ থিংস (Internet of things)। এটি একইসঙ্গে মানুষ ও ডিভাইস নিয়ে গড়ে ওঠা একটি বিশাল নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত ডিভাইসগুলি নিজেদের মধ্যেই ডাটা সংগ্রহ, শেয়ার ও পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী এই ডাটাগুলিকে কাজে লাগায়। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সবকিছুই বদলে দিবে এই “ইন্টারনেট অফ থিংস” বা আইওটি। শপিং থেকে শুরু করে কোথাও ঘুরতে যাওয়া কিংবা বাসার প্রয়োজনীয় কাজ করার মতো অনেক কাজই নিয়ন্ত্রণ করবে ইন্টারনেট অফ থিংস।
বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যাক, ইন্টারনেট অফ থিংস (IOT) হলো ইলেকট্রনিক ডিভাইস, সফটওয়্যার, সেন্সর ও নেটওয়ার্ক সংযোগের সঙ্গে যুক্ত ফিজিক্যাল অবজেক্ট। এটি এমন একটি নেটওয়ার্ক, যেখানে এম্বেডেড সেন্সর ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং পরিবর্তন করা সম্ভব। এর মাধ্যমে অনেক ডিভাইস একটি আরেকটির সঙ্গে ইন্টারনেট দ্বারা যুক্ত থাকে এবং তাদের মধ্যে ডাটা আদান-প্রদান করে।
আরও সহজভাবে বোঝার জন্য, প্রথমে জানতে হবে ইন্টারনেট কী? আমরা জানি, ইন্টারনেট হলো ইন্টারকানেক্টেড নেটওয়ার্ক। অর্থাৎ পৃথিবীর সকল নেটওয়ার্ক একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে সর্ববৃহৎ যে নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে সেটি ই হলো ইন্টারনেট। ইন্টারনেটকে সংযোগ ব্যবস্থাও বলা হয়। ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমরা একে-অপরের সাথে খুব সহজেই বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে তথ্য আদান-প্রদান ও যোগাযোগ করতে পারছি। ইন্টারনেট অফ থিংস এর “থিংস” অর্থ হলো বস্তু। এখানে থিংস বলতে বোঝানো হয়েছে স্মার্ট ইলেকট্রনিক ডিভাইসসমূহ। যেমন: ক্যামেরা, টিভি, ফ্রিজ, লাইট, অডিও সিস্টেম, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। সুতরাং “ইন্টারনেট অফ থিংস” হলো এমন একটি ধারণা যেখানে স্মার্ট ইলেকট্রনিক ডিভাইসসমূহ ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে-অপরের সাথে সংযুক্ত থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বা তথ্যের আদান-প্রদান এবং তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এই ধারণায় প্রতিটি থিংস (things), সেন্সর এর সাহায্যে তার আশেপাশের পরিবেশ থেকে তথ্য নিয়ে থাকে। সেন্সর হলো বহুল পরিচিত একটি যন্ত্র। এটি কনভার্টার হিসেবে কাজ করে থাকে। অর্থাৎ পরিবেশগত কোন পরিবর্তনকে তড়িৎ সিগন্যালে রূপান্তর করতে পারে। এটি শব্দ, তাপ, আলো ইত্যাদির প্রতি সাড়া দিতে পারে । বিভিন্ন প্রয়োজনীয় যন্ত্র বা জিনিসপত্রকে অটোমেটিক করার জন্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সাথে কম্পিউটার সিস্টেম সংযুক্ত করা হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, কাপড় ধোয়ার মেশিন। মেশিনটি কাপড়ের পরিমান এবং ওজন সেন্সর ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণ করে এরপর কাপড় ধোয়ার কাজটি অটোমেটিক ভাবে করে ফেলে। এছাড়াও যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস আইওটি’তে যুক্ত হতে পারে। অন্তত যেসব ডিভাইস অন-অফ করা যায়, সেগুলিই আইওটি এর আওতাভুক্ত হতে পারে। যেমন, আইওটি’তে সংযুক্ত থাকতে পারে স্মার্ট মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ডিভাইসটি কতক্ষণ কোন খাবার গরম করতে হয়, তা সেন্সর দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নির্ধারণ করতে পারে। আবার এতে যুক্ত থাকতে পারে ‘সেলফ ড্রাইভিং কার’, যেগুলো ড্রাইভার ছাড়াই বুঝতে পারে রাস্তায় কোথায় কী আছে। তাছাড়া ফিটনেস ডিভাইসও হতে পারে, যেটার সেন্সর ইউজারের হার্টবিট রেট বা সারাদিনে হাঁটার পরিমাণ হিসাব করে জানিয়ে দেবে তার কী পরিমাণ ব্যায়াম করা উচিত। ফুটবলেও এখন আইওটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফুটবলে থাকা সেন্সর দিয়ে হিসাব করা হচ্ছে কত স্পিডে বল কিক মারা হয়েছে অথবা বলটি কতদূর পর্যন্ত যাচ্ছে। তারপর সব ডাটার রেকর্ড রাখা হচ্ছে খেলোয়াড়দের ট্রেনিং এর কাজে লাগানোর জন্য। এইভাবে জিনিসপত্রের সিস্টেমের সাথে ইন্টারনেটের সংযোগ দেয়ার মাধ্যমকে বলা হয়, ইন্টারনেট সংযোজিত জিনিসপত্র বা ইন্টারনেট অফ থিংস। এই প্রযুক্তিতে ঘরের বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি যেমন টিভি, ফ্রিজ, লাইট এগুলো ইন্টারনেট এর সাথে সংযুক্ত থাকে এবং নেটওয়ার্কের এর সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে এগুলো দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করা যায়।
ইন্টারনেট অফ থিংস-এ যুক্ত থাকা ডিভাইসগুলোর বিল্ট-ইন সেন্সর থেকে প্রাথমিক ভাবে ডাটা সংগ্রহ করা হয়। এভাবে বিভিন্ন ডিভাইস থেকে সংগ্রহ করা ডাটা আইওটি প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করা হয়। এই শক্তিশালী আইওটি প্ল্যাটফর্মগুলো বুঝতে পারে কোন তথ্য বেশি জরুরি আর কোনটা বাদ দেয়া যায়। তারপর ডাটা অ্যানালাইসিস করে কোন ডাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি ঠিক করে কাজে লাগানো হয়। এভাবে সংগ্রহ করা ইনফরমেশন দিয়ে প্যাটার্ন শনাক্ত করা হয়, যাতে কোনো সংকট আসার আগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায়।
একটি উদাহরণ দেয়া যাক, যেমন আপনার একটি মুদির দোকান আছে। এখন আপনি জানতে চান আপনার দোকানের কোন পণ্যটি বেশি জনপ্রিয়। হতে পারে শুকনো খাবার কিংবা চকলেট আইটেম বেশি জনপ্রিয়। এখানে ইন্টারনেট অফ থিংস কে আপনি যেভাবে কাজে লাগাতে পারেন- আপনি দেখতে পারেন আপনার দোকানের কোথায় বেশি মানুষের ভিড় থাকে বা কোন জায়গায় ক্রেতারা বেশি সময় কাটায়। সেলস ডাটা থেকে দেখতে পারবেন কোন পণ্যের বিক্রি বেশি। সেলস ডাটা অনুযায়ী সাপ্লাই চেইন ঠিক করতে পারেন, যাতে বেশি বিক্রি হওয়া পণ্যগুলো স্টক শেষ না হয়ে যায়। এভাবে আইওটির সাথে কানেক্টেড ডিভাইস থেকে পাওয়া ডাটা ব্যবহার করে কী কী পণ্য স্টক করতে হবে, সেই ব্যাপারে আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আপনার বেশি সময়ও লাগবে না। ফলে আপনার সময় ও টাকা দুটি ই বাঁচবে।
আইওটির আরও আধুনিক অ্যানালিটিকস কাজে লাগিয়ে নানা ধরনের কাজ আরো দক্ষতার সাথে করা সম্ভব হবে। যেমন, অনেক ধরনের স্মার্ট অবজেক্ট বা সিস্টেম দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনেক কাজ করা যাবে। বিশেষ করে এমন সব কাজ, যেগুলো একঘেয়ে অথবা বার বার করা লাগে। এবং যেসব কাজ করতে বেশি সময় লাগে, সেগুলোও সহজেই করা যাবে।
IOT এর ইতিহাস
১৯৯৯ সালে বিল জয় তার সিক্স ওয়েব ফ্রেমওয়ার্ক এর অংশ হিসেবে ডিভাইস টু ডিভাইস (D2D) কমিউনিকেশন এর কথা কল্পনা করেন এবং তার এই ধারণা World Economic Forum এ প্রস্তাব করেন। ঐ বছরই MIT’র Auto-ID Centre এবং এর সাথে সম্পর্কিত মার্কেট এনালাইসিস পাবলিকেশন এর সুবাদে আইওটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। Auto-ID Centre এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কেভিন এজথ কে Radio Frequency Identification (RFID) নিয়ে অবগত করা হয়। তার পছন্দানুযায়ী এই পুরো ব্যাপারটার নামকরণ করা হয় ইন্টারনেট অফ থিংস (IOT)।
IOT এর প্রয়োগক্ষেত্র
ইন্টারনেট দ্বারা যুক্ত ডিভাইস বলতে আমরা বুঝি আমাদের কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, স্মার্টফোন এসবই। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এখন অনেক কিছুতেই ইন্টারনেট সংযুক্ত করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হবে। তারই কিছু উদাহরণ নিচে দেয়া হলো :-
স্মার্ট হোম তৈরিতে
স্মার্ট সিটি তৈরিতে
ইন্ডাস্ট্রি অটোমেশনে
মেডিক্যাল ও হেলথ কেয়ারে
শিক্ষা ক্ষেত্রে
সিকিউরিটি ব্যবস্থায়
যোগাযোগ ব্যবস্থায়
কৃষি ক্ষেত্রে
IOT এর ব্যবহার
IOT এর উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই চলে আসে স্মার্ট হোম (smart home) এর কথা । কি না হয় এই স্মার্ট হোমের সাহায্যে! IOT যুক্ত স্মার্ট হোমের মাধ্যমে একজনের লাইফস্টাইল অ্যাপের মাধ্যমে ট্র্যাক রাখা যায়। ধরেন আপানি একটি স্মার্ট ওয়াচ পরে রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছেন। স্মার্ট ওয়াচটি তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আপনার প্রতিটি ফুটস্টেপ ও ব্লাড প্রেশার কাউন্ট করবে। এরপর ধরেন, হঠাৎ আপনার মনে পড়লো আপনি বাসার দরজা লক করতে ভুলে গিয়েছেন। তখন অ্যাপের মাধ্যমে আপনি আপনার স্মার্ট হোমের দরজাটি লক করে দিতে পারবেন। এরপর ধরেন, আপনার ঘড়িটি আপনার স্মার্ট ফোন এ সংযুক্ত যা আবার আপনার রুমের স্মার্ট হোম এসিস্টেন্ট এর সাথে যুক্ত । আপনার স্মার্ট হোম পূর্বের ডাটা থেকে জানে যে, আপনাকে সকাল ৯ টায় কাজে যেতে হবে। এদিকে আপনি হাঁটতে হাঁটতে ০৮:০০ বাজিয়ে ফেলেছেন। স্মার্ট হোম আপনাকে ফোনের মাধ্যমে জানিয়ে দিবে আপনার ঘরে ফেরার সময় হয়েছে । এবং সে আপনার স্মার্ট ওয়াচের মাধ্যমে এটিও জানে আপনি হেঁটে আসছেন এবং আপনার ব্লাড প্রেশার বেড়ে আছে। তাই সে আপনার বিশ্রাম নেওয়ার জন্য স্মার্ট ইউটিলিটিগুলোকে চালু করে দিবে। যদি ঘরে কোন রোবট থাকে তাকে দিয়ে রান্না করাবে। অথবা অন্য ইলেকট্রনিক সামগ্রী থাকলে সেটি চালু করে আপনার ব্রেকফাস্ট তৈরী করে ফেলবে। সেইসাথে বাসায় ফিরে আপনার গোসলের জন্য ১০ মিনিট বসে থেকে গিজারে পানি গরম করতে হবে না, স্মার্ট হোম আপনার ফেরার আগেই গিজারের সুইচ অন করে রেখে দিবে। এরপর আপনি তৈরী হয়ে কাজে বেরিয়ে গেলে সে আপনার বাসার সকল ডিভাইস সমুহকে বন্ধ করে দিবে। এই সবটাই হবে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল ডিভাইস সংযোগের ফলে অর্থাৎ IOT।
এছাড়াও আইওটি এর মাধ্যমে আরও অনেক কাজ করা যাবে। আমাদের ব্যস্ত জীবনের অস্থির কল্যাণ বয়ে আনবে এই ইন্টারনেট অফ থিংস। ভবিষ্যতের মডার্ন পৃথিবীতে IOT এর প্রাধান্য থাকবে সবচেয়ে বেশি। IOT এর ব্যবহার এত ব্যাপক হবে যে প্রায় সব ডিভাইসগুলোই IOT কানেক্টেড হয়ে যাবে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন সেন্সর ইন্টারনেট এর সাথে কানেক্টেড হবে অর্থাৎ আইওটি আরো অনেক সম্প্রসারিত হবে। এই ছিলো IOT এর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। যেকোনো প্রশ্ন জাগলে নির্দ্বিধায় কমেন্টবক্সে কমেন্ট করুন। এবং টেকনোলজি সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। সেইসাথে আমাদের অন্যান্য আর্টিকেলগুলোও পড়তে পারেন। ধন্যবাদ।