আমরা অনেকেই ভেবে দেখিনা যে কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে। শুধুমাত্র কম্পিউটারকে কমান্ড দিয়ে যাই এবং এর বদলে কম্পিউটার আমাদের কাজ সম্পন্ন করে দেয়। কিন্তু আমাদের কমান্ড দেওয়ার পর কাজটি করার জন্য কম্পিউটারকে অনেকগুলো প্রসেস সম্পূর্ণ করতে হয়, সে বিষয়টি আমাদের অনেকের কাছে অজানা। যে প্রোগ্রামগুলোর সাহায্যে আমরা কম্পিউটারে বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করি, যেমন- মিউজিক ভিডিও প্লে, ডকুমেন্ট তৈরি, ইমেইল সেন্ড ইত্যাদি এগুলোকে অ্যাপ্লিকেশন বলা হয়। আর এই সব অ্যাপ্লিকেশনগুলো যেখানে রান হয় বা যার উপর দিয়ে চলে তাকে অপারেটিং সিস্টেম বলা হয়।
অপারেটিং সিস্টেম কম্পিউটারের সকল বেসিক কাজ গুলো সম্পন্ন করে। যেমন আমরা কম্পিউটারকে কোনো কমান্ড দেওয়ার সাথে সাথে কম্পিউটার আমাদের কাজ করে দেয়। এছাড়া ও কম্পিউটারের প্রসেসর বিভিন্ন সময় গরম হয়ে গেলে অটোমেটিক কুলিং ফ্যান চালু হয়ে যায়। এই সব কাজগুলো অপারেটিং সিস্টেমই সম্পাদন করে। অ্যাপ্লিকেশন আমাদের দেয়া কমান্ড অনুসরণ করে অপারেটিং সিস্টেমের উপর কাজ চাপিয়ে দেয় এবং হার্ডওয়্যারের সাথে সংযোগ তৈরি করে।
বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম হলো উইন্ডোজ। উইন্ডোজ তার নিজের ক্ষেত্রে থেকে অনেক ভালো জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। কিন্তু উইন্ডোজ বা ম্যাক অপারেটিং সিস্টেম গুলো ইউজার এবং ডেভেলপারদের যা ইচ্ছে তা করার অনুমতি প্রদান করে না। উইন্ডোজ তৈরি হয়েছিল সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য। তাই মাইক্রোসফট উইন্ডোজকে সাধারণ ব্যবহারকারীর জন্য যতটা উপযোগী করতে পেরেছে, প্রোগ্রামিংয়ের জন্য ততটা উপযোগী করে তৈরি করতে পারেনি। এটির কারণ হচ্ছে উইন্ডোজ গঠন-কাঠামো। উইন্ডোজ একটি ক্লোজড অপারেটিং সিস্টেম। কখনো কোনো সমস্যা হলে উইন্ডোজ একটি হেক্সাডেসিমেল এরর কোড ব্যবহারকারীকে দেখায় কিন্তু কোনো বিস্তারিত তথ্য দেখায় না। ফলে সমস্যাটা ব্যবহারকারী জানতে পারে না। আবার উইন্ডোজ ডায়াগনসিস নিজে নিজে অনেক সমস্যার সমাধান করে দেয়। ফলে আসল সমস্যাটি কী হয়েছিল এবং সেটি কীভাবে সমাধান হলো সেটিও ব্যবহারকারী জানতে পারে না। একজন উইন্ডোজ ব্যবহারকারী এডমিন হয়েও অনেক ফাইল মোডিফাই করতে পারে না। এই সমস্যাগুলো সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, একজন প্রোগ্রামার বা ডেভলপারের কাছে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়গুলো থেকে বঞ্চিত করার মানে হলো একজন প্রোগ্রামার বা ডেভেলপারের কাছে পরাধীনতা। তাই তাদের কাছে লিনাক্স সবচেয়ে উত্তম। এক্ষেত্রে যুক্তি ও রয়েছে, লিনাক্স সম্পূর্ণ ফ্রী একটি কার্নেল। এটির সবকিছু খোলা। যে কেউ চাইলে সিস্টেমের যেকোনো অংশ দেখতে পারবে। যে কেউ চাইলেই জানতে পারবে লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম বিভিন্ন ডিভাইসের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করে বা কীভাবে সিগন্যাল গ্রহণ করে কাজ সম্পন্ন করে। লিনাক্স সবকিছু জানার সুযোগটা পুরোপুরি দিয়ে থাকে। উইন্ডোজের কার্নেলটা কেউ কয়েক বিলিয়ন ডলার দিয়েও পাবে না। কিন্তু লিনাক্সের কার্নেল ইন্টারনেট সংযোগ আছে এমন যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় দেখতে পারবে, নিজের মতো পরিবর্তন করতে পারবে, নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারবে এবং অন্যকে দিতে পারবে। লিনাক্সে নিরাপত্তার ভয় নেই। কারণ এটির নিরাপত্তা আপডেটগুলো সব সময় চলমান থাকে। যেকোনো নিরাপত্তা-ত্রুটির জন্য প্যাচ (patch) পাওয়া যায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। সে জন্য ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। লিনাক্স সিস্টেমের ফাইল/প্রোগ্রামগুলো সামান্য পরিবর্তন করতে হলেও পাসওয়ার্ড লাগে। তাই কোনো ক্ষতিকর প্রোগ্রাম চাইলেও সিস্টেমের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। লিনাক্সের প্রায় সব সফটওয়্যার ডিস্ট্রিবিউটরদের নিজস্ব নিরাপদ রিপোজিটরিতে থাকে। সেখানে ম্যালওয়্যার থাকার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। আর থার্ডপার্টি পরিচিত সফটওয়্যারগুলো নিজস্ব ওয়েবসাইটে থাকায় সেগুলো ব্যবহার করা যায় নিরাপদে। তাই নিরাপদ থাকতে, নিজের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে লিনাক্স একমাত্র নির্ভরযোগ্য অপারেটিং সিস্টেম। এবং লিনাক্সকে নিজের ইচ্ছামতো সাজানো যায়, কনফিগার করা যায়। যেটি লিনাক্সের অন্যতম বড় শক্তি।
বর্তমানে লিনাক্স অন্যতম জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। লাইট বাল্ব থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, ল্যাপটপ থেকে বিশাল কম্পিউটার সার্ভার, লিনাক্স প্রায় যেকোনো ধরনের সিস্টেম চালাতে সক্ষম। ফোন থেকে শুরু করে রেফ্রিজারেটর, দৈনন্দিন সব স্মার্ট গ্যাজেট লিনাক্স দিয়ে চালানো যায়। বিভিন্ন গেমিং কনসোল, স্মার্ট টিভি, সবক্ষেত্রেই লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার হয়।
লিনাক্স এর ইতিহাস
১৯৯০ সালে ফিনিশ সফটওয়্যার ডেভেলপার Linus Torvalds প্রথম লিনাক্স তৈরী করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম এর কোর ভার্সন (Version 1.0) রিলিজ করেন। এরপর বিভিন্ন ডেভেলপার এর হাত ধরে বর্তমানে এটি মহীরুহে পরিণত হয়েছে। “লিনাক্স” নামটি লিনুস টোরভাল্ডস এর দেওয়া নাম নয়। লিনাক্সের নামকরণের কৃতিত্ব আরি লেমকের। তিনি হেলসিংকি ইন্সটিটিউট অফ টেকনলজিতে ftp.funet.fi নামক একটি এফটিপি সার্ভারের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সার্ভারটি ছিল ফিনীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা নেটওয়ার্ক এর একটি অংশ, আর এই নেটওয়ার্ক এর সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি ছিল লিনুসের ইউনিভার্সিটি অফ হেলসিংকি। লিনুস যখন তার অপারেটিং সিস্টেম প্রকল্পটি এই সার্ভারটিতে রক্ষা করার জন্য লেমকে কে দেন, লেমকে তখন সেটি ডিরেক্টরিতে রাখেন ও ডিরেক্টরিটির নাম দেন “লিনাক্স”, যার অর্থ “লিনুসের মিনিক্স”। কিন্তু লিনুস তার প্রকল্পটির নাম “ফ্রিক্স” (freax) রাখতে চেয়েছিলেন, যা ছিল “ফ্রি” ও ইউনিক্সের শেষ অক্ষর “এক্স” এর সম্মিলিত রূপ। তবে শেষ পর্যন্ত লেমকের দেয়া লিনাক্স নামটিই রয়ে যায়। লিনাক্সের ম্যাসকট এবং লোগো হচ্ছে টাক্স নামের একটি পেঙ্গুইন। ১৯৯৬ সালে ল্যারি ইউয়িং এর আঁকা একটি ছবি থেকে টাক্স পেঙ্গুইন আঁকার অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে। টাক্স ছাড়াও ওএস ট্যান ও আরও কিছু লিনাক্স প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্র রয়েছে, তবে এগুলো খুব প্রচলিত নয়।
লিনাক্স কি
লিনাক্স হল একটি “কার্নেল”, অপারেটিং সিস্টেম সফটওয়্যারের প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী অংশ। বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেম যেমন উবুন্টু, কুবুন্টু, রেড হ্যাট ইত্যাদি লিনাক্স কার্নেলের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। এমনকি অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমও লিনাক্স কার্নেলের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। “লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম” – বলতে মূলত লিনাক্স কার্নেলের উপর ভিত্তি করে তৈরী করা অপারেটিং সিস্টেমকে বলা করা হয়। সহজ ভাষায়, কার্নেল হলো একটি অপারেটিং সিস্টেমের অংশ যা ডিভাইসের হার্ডওয়্যার এবং অন্যান্য সফ্টওয়্যার উপাদানগুলোকে সংযুক্ত করে। যেমন, ল্যাপটপে ক্যামেরা সফটওয়্যারটি ক্লিক করা হলে, কার্নেল ক্যামেরা সফটওয়্যার থেকে নির্দেশাবলী সহ ক্যামেরা হার্ডওয়্যারের সাথে যোগাযোগ করে। তারপর ক্যামেরা চালু হয়ে স্ক্রিনে দেখায়।
লিনাক্স ইন্টেল এক্স-৮৬ আর্কিটেকচারের উপর ভিত্তি করে কম্পিউটারের জন্য ডেভেলপ করা হয়েছে। কিন্তু, বর্তমানে এটি অন্য সকল অপারেটিং সিস্টেমের চেয়ে বেশি প্ল্যাটফর্মে পোর্ট করা হচ্ছে ও ব্যবহার করা হচ্ছে। স্মার্টফোন জগতে লিনাক্স এর কার্নেল ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম “অ্যান্ড্রয়েড” আধিপত্যের কারণেই অন্যসব অপারেটিং সিস্টেমের তুলনায় এটির সবচেয়ে বড় ইন্সটল বেস তৈরি হয়েছে। লিনাক্স সার্ভার এবং অন্যান্য বড় আইরন সিস্টেম, যেমন মেইনফ্রেম কম্পিউটার এবং সারা দুনিয়ার টপ ৫০০ সুপারকম্পিউটারে ব্যবহৃত একমাত্র অপারেটিং সিস্টেম হচ্ছে লিনাক্স। লিনাক্স মুলত ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে অন্য সব প্রতিযোগী অপারেটিং সিস্টেমকে ধীরে ধীরে সরিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে প্রায় ৬% কম্পিউটারে লিনাক্স ব্যবহার করা হয়।
কার্নেল ও অপারেটিং সিস্টেম
অপারেটিং সিস্টেম হলো সিস্টেম সফ্টওয়্যার, যা কম্পিউটার পরিচালনা করে। এর কাজ হচ্ছে কম্পিউটারের সম্পদগুলি পরিচালনা এবং তাদের যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা মেটানো। কার্নেল হলো অপারেটিং সিস্টেমের প্রধান অংশ যা হার্ডওয়্যার এর রিসোর্সগুলির সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে থাকে। কার্নেল ছাড়া অপারেটিং সিস্টেম কাজ করতে পারে না। কার্নেল একটি অপারেটিং সিস্টেমের প্রধান অংশ। এটি হার্ডওয়্যার এবং অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যারের মধ্যকার সেতু। কার্নেল হার্ডওয়্যার ও সফ্টওয়্যার যোগাযোগ সহ সিস্টেম রিসোর্সের পরিচালনা করে।
আগেই বলেছি, প্রত্যেকটি অপারেটিং সিস্টেমে কার্নেল রয়েছে এবং কার্নেল একসাথে অনেক গুলো অ্যাপলিকেশন মিলিয়ে কাজ করে, শুধু একা কার্নেল কখনোই একটি অপারেটিং সিস্টেম সম্পূর্ণ রান করাতে সক্ষম নয়। কার্নেলের সাথে অবশ্যই আলাদা আলাদা অ্যাপ্লিকেশনের প্রয়োজন পড়ে। যেমন- টার্মিনালের কম্যান্ড প্রমট ডিসপ্লে করানোর জন্য, অ্যাপ্লিকেশন রান করানোর জন্য, কোন ফোল্ডার ন্যাভিগেট করার জন্য এবং আরো অনেক কাজ করার জন্য “সেল (Shell)” এর প্রয়োজন পরবে। তাই লিনাক্স নির্ভর অপারেটিং সিস্টেম বা লিনাক্স ডিস্ট্রো গুলোতে কার্নেলের সাথে অনেক অ্যাপলিকেশন বান্ডেল করানো থাকে। যেমন- ওয়েব ব্রাউজার, ডেস্কটপ এনভায়রনমেন্ট, অফিস সুইট ইত্যাদি। যার ফলে সরাসরি গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেসে ব্যবহার করা যায়। অ্যাপলিকেশন বান্ডেল ছাড়া কার্নেল একা তেমন কিছুই করতে পারে না, আবার কার্নেল ছাড়া অপারেটিং সিস্টেম রান করতে পারে না।
লিনাক্স এর ডিস্ট্রিবিউশন
যেসব অপারেটিং সিস্টেম লিনাক্সকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে তাদেরকে লিনাক্স ডিস্ট্রো বা লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশন বলা হয়। যখন কার্নেলের সাথে অনেক সফটওয়্যার যোগ করা হয়, তখন তা পরিণত হয় একটি ডিস্ট্রিবিউশনে। যেমন,
Gnome + Firefox + Totem + OpenOffice + Linux = Ubuntu
লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের বিভিন্ন ডিস্ট্রিবিউশন রয়েছে যা সব ধরণের ব্যবহারকারীদের জন্য উপযুক্ত। নতুন ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে হার্ড-কোর ব্যবহারকারী সকলের জন্য আলাদা ডিস্ট্রিবিউশন রয়েছে। সমস্ত লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশন খুব সহজে ও বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়। এবং ডিস্কে ইনস্টল করা যায়। লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশনগুলো বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সহ হয়। বর্তমানে ৫৫০ এরও বেশি লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশন রয়েছে। নিচে কিছু জনপ্রিয় লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশনের নাম দেওয়া হলো :-
Fedora Core
Corel Linux
SUSE Linux
Turbo Linux
Lycoris Linux
CentOS Linux
Clear OS Linux
Ubbuntu Linux
FreeBSD Linux
PCLinuxOS Linux
RedHat Enterprise Linux
লিনাক্সে অসংখ্য ডিস্ট্রো থাকায় নতুনদের কাছে ডিস্ট্রো পছন্দ করা বা কোনটা দিয়ে শুরু করবো এসব নিয়ে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হয়। আর ডিস্ট্রো-ফাইট তাদেরকে অনেকসময় আরো কনফিউজ করে দেয়। লিনাক্স ব্যবহারকারীরা সাধারণত নিজের ব্যবহারকৃত ডিস্ট্রোর গুণগান একটু বেশী করে এবং অন্য ডিস্ট্রোকে তেমন পাত্তা দেয় না। এটা সবারই ব্যক্তিগত অভিমত। জেনে রাখা ভালো, সব লিনাক্স ডিস্ট্রো নির্দিষ্ট কাজ অনুযায়ী কাস্টমাইজ করা থাকে, তাই প্রতিটি ডিস্ট্রোর নিজস্ব দিক রয়েছে। যেমন, আপনার কাজ যদি হয় পেনেট্রেশন টেস্টিং অথচ আপনি ব্যবহার করলেন জরিন ওএস তাহলে হবে না। এমন হলে লিনাক্স ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। তাই এক্ষেত্রে আপনার উচিত অপরের এবং নিজের প্রয়োজন বুঝে চিন্তা করা ও সিদ্ধান্ত নেয়া। আমার মতামত অনুযায়ী, আপনি যদি নতুন কম্পিউটার ব্যবহারকারী বা উইন্ডোজ/ম্যাক থেকে প্রথম লিনাক্স ব্যবহার করতে আসেন, তাহলে আপনার জন্য সবচেয়ে ভালো ডিস্ট্রো হচ্ছে উবুন্টু অথবা লিনাক্স মিন্ট বা লিনাক্স ডিপিন। এখানে উল্লেখ্য উবুন্টু হচ্ছে ডেবিয়ান বেসড ডিস্ট্রো আর মিন্ট ও ডিপিন হচ্ছে উবুন্টু বেসড। মানে ডেবিয়ান হচ্ছে এখানে মূল ডিস্ট্রো, ডেবিয়ানকে ক্যানোনিকাল কিছু কাস্টোমাইজ করে উবুন্টু বানানো হয়েছে এবং উবুন্টুকে কিছু কাস্টোমাইজ করে মিন্ট এবং ডিপিন বানানো হয়েছে। এখানে মূল ডিস্ট্রোকে কিছু পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন করে ডেরিভেটিভ ডিস্ট্রোগুলো বানানো হয়েছে যাতে ব্যবহারকারীদের কাছে সহজ এবং বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হয়। এবং উবুন্টু ও মিন্ট সর্বসাধারণের কথা ভেবে বানানো হয়েছে। ডেবিয়ান বেস ছাড়া নতুন ব্যবহারকারী হিসেবে সুস ব্যবহার করা যায়, এটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট বা মূল ডিস্ট্রো (ডেবিয়ানের মত)। এছাড়াও ফেডোরা, জরিন, নেটরানার ইত্যাদি রয়েছে।
লিনাক্স এর বৈশিষ্ট্য
১. Hardware layer – এই হার্ডওয়্যার স্তরটিতে সমস্ত পেরিফেরাল ডিভাইস রয়েছে র্যাম / এইচডিডি / সিপিইউ ইত্যাদি।
২. Kernel – এটি মূল উপাদান যা সরাসরি হার্ডওয়্যারের সাথে যোগাযোগ করে এবং উপরের স্তর উপাদানগুলোকে নিম্ন স্তরের পরিষেবা সরবরাহ করে।
৩. Shell – এটি কার্নেলের একটি ইন্টারফেস যা ব্যবহারকারীদের থেকে কার্নেলের ফাংশনগুলোর জটিলতা আড়াল করে। এই শেল ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে আদেশ নিয়ে যায় কার্নেলের কাছে এবং কার্নেল কার্য সম্পাদন করে। এটি লিনাক্স এর মধ্যে একটি বিশেষ interpreter program যার মাধ্যমে operating system এর commands গুলোকে execute করা হয়। এটার ব্যবহারে বিভিন্ন ধরণের ক্রিয়াকলাপ করা হয়। যেমন, application programs গুলোকে call করা।
৪. Open Source – লিনাক্স সোর্সকোড বিনামূল্যে পাওয়া যায়, এবং এটি একটি community based development project। অনেকগুলো টিম কাজ করে থাকে লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম এর ক্ষমতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে।
৫. Multi-User – এটির অর্থ হলো বিভিন্ন system resources যেমন memory/ ram/ application প্রোগ্রামস গুলোকে multiple users দ্বারা একসাথে এক্সেস করা যায়।
৬. Hierarchical File System – লিনাক্স একটি standard file structure প্রদান করে থাকে, যেখানে system files / user files গুলোকে সহজেই সাজানো (arranged) যায়।
৭. Security – লিনাক্স তার user দের অনেক ভালো রকমের security features প্রদান করে থাকে। যেমন, ফাইল এর মধ্যে password protection/ controlled access এবং encryption of data প্রদান করে থাকে।
লিনাক্স এর সুবিধা
লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম এর অনেক সুবিধা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলো হলো :-
- এটি বিনামূল্য এবং ওপেন সোর্স সফ্টওয়্যার, তাই বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়।
- অন্যান্য অপারেটিং সিস্টেমের তুলনায় ম্যালওয়্যার থেকে বেশি সুরক্ষিত।
- অন্য যেকোনো কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেমের তুলনায় এটিতে বেশি আপডেট রয়েছে।
- লিনাক্স এর কোর কাস্টমাইজেশনের সাথে যেকোনো বৈশিষ্ট্য যোগ করা বা মুছে ফেলা তুলনামূলকভাবে সহজ।
- অনেক ডিস্ট্রিবিউশন সহ, নিজের পছন্দমতো লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম বেছে নেয়া যায়।
- ইন্টারনেটে বিভিন্ন ফোরামের মাধ্যমে অসাধারণ সম্প্রদায় সমর্থন পাওয়া যায়।
- এটি অপ্রয়োজনীয়ভাবে কোনো ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহ করে না।
- বিভিন্ন নেটওয়ার্ক এবং ওয়ার্কস্টেশনে উচ্চ কর্মক্ষমতা প্রদান করতে সক্ষম।
- নেটওয়ার্কিং সুযোগগুলো লিনাক্সে ব্যবহার করা সুবিধাজনক।
এছাড়াও কম্পিউটার যদি পুরোনো হয় অর্থাৎ লো কনফিগারেশনের হয়, তাহলে লিনাক্স হলো অপরিহার্য একটি অপারেটিং সিস্টেম। কারণ উইন্ডোজের সংস্করণগুলো চালানোর জন্য মোটামুটি ভালো হার্ডওয়্যারের দরকার পড়ে। কিন্তু লিনাক্স খুব লো-কনফিগের পিসিতেও যথেষ্ট ভালো সাপোর্ট দেয়। লিনাক্স চালাতে অ্যান্টি-ভাইরাসেরও দরকার পড়ে না। কারণ লিনাক্সের জন্য তেমন ক্ষতিকর ভাইরাস নেই। এবং সেজন্য রিসোর্স হাংরি অ্যান্টি-ভাইরাস চালানোর তেমন দরকার হয় না, যে কারনে কম্পিউটারটিকে আরো দ্রুত চলতে পারে। লিনাক্স ব্যবহার করলে কম্পিউটার বারবার রিফ্রেশ করতে হয় না। কারণ এটি সবসময় প্রসেস ও ফাইল ইনডেক্স করতে থাকে, যার কারণে কাজ হয় আরো দ্রুত। কোডিং, ডেভেলপিং ইত্যাদি কাজ লিনাক্সে বেশ ভালো সার্ভিস দেয়। অন্যদিকে যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য অ্যাক্টিভ ফোরামও রয়েছে।
লিনাক্স এর অসুবিধা
লিনাক্স এর মধ্যেও কিছু অসুবিধাও রয়েছে। সেগুলো হলো :-
- এটির সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ড্রাইভারের অভাব। যেহেতু লিনাক্স ওপেন সোর্স তাই ড্রাইভার কোম্পানী তাদের জন্য কোনো ড্রাইভার তৈরি করে না। কারণ কেউ ফ্রিতে কিছু দিতে চায় না, তাই লিনাক্স ব্যবহার করলে ড্রাইভারের সমস্যা হবে। যদিও এই সমস্যা দিন দিন কমছে কিন্তু এর কোনো সহজ সমাধান এখনও বের হয়নি।
- লিনাক্স দিয়ে গেম খেলতে গেলে ঝামেলায় পড়তে হয়। যদিও লিনাক্সের একটি গেম-টার্গেটেড ডিস্ট্রো রয়েছে, কিন্তু উইন্ডোজের মতো নয়। সুতরাং গেম খেলতে চাইলে উইন্ডোজ ব্যবহার করতে হবে।
- লিনাক্স এর সাথে ব্যবহারকারীদের সামঞ্জস্য হতে সময় লাগে। কারণ গড় ব্যবহারকারী একটি গ্রাফিকাল ইন্টারফেস থেকে বেরিয়ে এসে লিনাক্সের টার্মিনাল ব্যবহার করে অ্যাপ বা প্যাকেজ ইনস্টল করতে বাঁধার সম্মুখীন হয়।
লিনাক্স এর কমান্ড
ls : এটি বর্তমান ডিরেক্টরি সামগ্রীর তালিকা তৈরি করবে।
cd : এটির সাহায্যে আপনি আপনার বর্তমান ডিরেক্টরিটি পরিবর্তন করতে পারেন।
cat : এটির সাহায্যে আপনি স্ক্রিনে ফাইলের সামগ্রী প্রদর্শন করতে পারবেন, এটির সাথে টেক্সট ফাইলগুলি অনুলিপি এবং একত্রিত করতে পারেন।
history : এটি থেকে আপনি স্ক্রিনে সমস্ত কার্যকর করা কমান্ড তালিকা দেখতে পাবেন।
chmod : এটির সাহায্যে আপনি ফাইলের অনুমতি পরিবর্তন করতে পারেন।
chown : এটির সাহায্যে আপনি ফাইলের মালিক পরিবর্তন করতে পারেন।
clear : এটি থেকে আপনি নতুন শুরুর জন্য পর্দা সাফ করতে পারেন।
df : এটি থেকে আপনি ব্যবহৃত এবং উপলভ্য ডিস্কের স্থান দেখতে পারেন।
date : এটি থেকে আপনি বর্তমান সিস্টেমের তারিখ এবং সময় প্রদর্শন করতে পারেন।
du : এ থেকে আপনি জানতে পারবেন কোন ফাইল থেকে কত স্থান নেওয়া হয়েছে।
লিনাক্স কি ভাইরাস মুক্ত?
লিনাক্স সম্পূর্ণ ভাইরাস / ম্যালওয়্যার মুক্ত না। বিশ্বে কোনও ওএস নেই যা ১০০% ভাইরাস এবং ম্যালওয়্যার মুক্ত। তবে বলা বাহুল্য, যদি উইন্ডোজের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে লিনাক্সে এখন পর্যন্ত কোনো বৃহত্তর ম্যালওয়্যার সংক্রমণ হয়নি। আবার এটিও সত্য যে লিনাক্স ওএস ব্যবহারকারী সংখ্যা খুব কম, যদি আমরা এটি মাইক্রোসফ্ট ব্যবহারকারীদের সাথে তুলনা করি। লিনাক্স ব্যবহারকারী খুব কম হওয়ায় এটির অনেক ভাইরাস নেই। অন্যদিকে বলা বাহুল্য, লিনাক্স স্থাপত্যগতভাবে খুব শক্তিশালী ও সুরক্ষিত। কারণ লিনাক্সে মূল পাসওয়ার্ড ছাড়া এবং ব্যবহারকারীর পাসওয়ার্ড ছাড়া সিস্টেম সেটআপ করা যায় না। এর অর্থ লিনাক্সের প্রতিটি ব্যবহারকারীর নিজস্ব পাসওয়ার্ড রয়েছে। উইন্ডোজ ব্যবহারকারীরা পাসওয়ার্ড ছাড়াই একটি প্রোফাইল তৈরি করতে পারে। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে, লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম এর ভাইরাস এবং ম্যালওয়ারের ভয় খুব কম।
লিনাক্স এবং উইন্ডোজ এর পার্থক্য
১. খরচ :- লিনাক্স ও উইন্ডোজ এর মূল পার্থক্য হল এর খরচ। লিনাক্স একটি ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম, যেখানে এটির বিভিন্ন ডিসট্রিবিউশন খুবই সহজে ও বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু উইন্ডোজ একটি পেইড সিস্টেম। যেখানে একটি নির্দিষ্ট ফি এর মাধ্যমে মাইক্রোসফট থেকে কিনতে হয়।
২. অপারেটিং কার্নেল :- লিনাক্স মনোলিথিক কার্নেল এর উপর ভিত্তি করে অনেক দ্রুত কাজ করে। অপরদিকে উইন্ডোজ মাইক্রো কার্নেল এর উপর কাজ করে তাই তুলনামূলক ভাবে কিছুটা ধীরে কাজ করে।
৩. ফাইল সিস্টেম :- লিনাক্স এ সবকিছু ফাইল হিসাবে গণ্য হয়। সেটি ইন্টারনাল ফাইল ফোল্ডার বা নানা পেরিফেরাল ডিভাইস, মাউস কীওয়ার্ডও হতে পারে। অপরদিকে উইন্ডোজ এর ফাইল এটির বিন্যাস ফোল্ডার আর ডিরেক্টরি নির্ভর।
৪. সিকিউরিটি :- উইন্ডোজ ব্যবহারকারী সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার কারণে এখানে বিভিন্ন হ্যাকার ভাইরাস অ্যাটাক করে থাকে। লিনাক্স ওপেনসোর্স হওয়াতে এখানে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা অনেক বেশি। এখানে ব্যবহারকারী কম হওয়াতে ভাইরাস,স্প্যাম এর পরিমান অনেক কম। এছাড়া প্রাইভেসি এর ক্ষেত্রে লিনাক্স দারুন। কিন্তু উইন্ডোজ এর ক্ষেত্রে অনেক সময় ডাটা লিক এর সম্ভবনা তৈরী হয়।
৫. ডিভাইস কম্প্যাটিবিলিটি:- ডিভাইস কম্প্যাটিবিলিটি এর দিক থেকে উইন্ডোজ এগিয়ে। কারণ সিংহভাগ পিসি তে উইন্ডোজ ব্যবহার হওয়াতে নানা সংস্থা উইন্ডোজ এর কথা ভেবেই হার্ডওয়্যার ডিভাইস তৈরী করেন। তাই লিনাক্স এই ক্ষেত্রে একটু পিছিয়ে।
এছাড়া উইন্ডোজের অপারেটিং সিস্টেম ইন্টারফেস খুবই সহজ তাই যেকোনো ব্যবহারকারী স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করতে পারে। প্রথমবার কম্পিউটার ব্যবহারকারী উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে যতটা সহজে কাজ করতে পারে, লিনাক্স ব্যবহার করা ততটা সহজ নয় শুরুতে। তবে সময়ের সাথে সাথে লিনাক্স ব্যবহার খুব সহজ এবং আয়ত্তে চলে আসে। এবং বর্তমানে বিভিন্ন লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশন (যেমন – উবুন্তু, রেডহ্যাট) খুব সহজে লিনাক্স ব্যবহার করতে দিচ্ছে।
লিনাক্স হলো ভবিষ্যতের অপারেটিং সিস্টেম। কারণ প্রায় সমস্ত সর্বশেষ প্রযুক্তিতে এটির উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। খুব সম্ভবত লিনাক্স ছাড়া ভবিষ্যতের কোনও প্রযুক্তি কল্পনা করা যাবে না। সমস্ত বড় সংস্থা এখন অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে লিনাক্সকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে। যেহেতু এর মধ্যে অনেক দুর্দান্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাই তাদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অনেক সিস্টেম প্রশাসকরা তাদের কাজের প্রোফাইলটি উইন্ডোজ থেকে লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমে পরিবর্তন করছেন বলে জানা গিয়েছে। সুতরাং বলা যায়, লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম এর ভবিষ্যৎ হবে অনেক উজ্জ্বল।
এই ছিলো লিনাক্স সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। যেকোনো প্রশ্ন জাগলে নির্দ্বিধায় কমেন্টবক্সে কমেন্ট করুন। এবং টেকনোলজি সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। সেইসাথে আমাদের অন্যান্য আর্টিকেলগুলোও পড়তে পারেন। ধন্যবাদ।