উইলিয়াম হেনরি গেটস যাকে আমরা বিল গেটস নামে চিনি, তিনি আর কেউ নন বিখ্যাত কম্পিউটার সফটওয়্যার কোম্পানি মাইক্রোসফ্ট এর প্রতিষ্ঠাতা। প্রায় ১৫ বছর ধরে ধনীদের তালিকায় শীর্ষস্থান ধরে রাখা আমেরিকান এই বিজনেস ম্যাগনেট Microsoft কোম্পানীর Chairman, Chief Executive Officer, প্রধান Software Architect প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। আমরা বর্তমানে যে Personal Computer ব্যবহার করি সেটি সহজলভ্যতা ও প্রত্যেকের বাড়িতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে অমূল্য অবদান রয়েছে তার। সেজন্য তাকে “Pioneers of Microcomputer Revolution” বা “মাইক্রো কম্পিউটার বিপ্লবের জনক” ও বলা হয় ।
বিল গেটস এর ব্যাক্তিগত জীবন
বিল গেটস এর পুরো নাম হলো উইলিয়াম হেনরী গেটস। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের সিয়াটল এলাকায় ১৯৫৫ সালের ২৮ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বড় হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের সিয়াটলে। তার পিতার নাম উইলিয়াম এইচ গেটস এবং মাতার নাম মেরি ম্যাক্সওয়েল। তার বাবা ছিলেন সিয়াটলের একজন বিখ্যাত ধনী উকিল, আর মা ছিলেন একজন ধনী ব্যাংকারের মেয়ে। তার মা “United Way” নামের একটি কোম্পানির “First Interstate BancSystem” এর Board of director হিসেবে চাকরি করতেন। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে তিনি আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তারা তিন ভাই-বোন ছিলেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে বিল ই ছিলেন একমাত্র ছেলে। তার বড় বোনের নাম ক্রিস্টিয়েন এবং ছোট বোনের নাম লিব্বি। বিল গেটসের একটি ছোট নাম রয়েছে, পরিবারের লোকেরা তাকে ‘ট্রে’ বলে ডাকেন।
বিল গেটস ১৯৯৪ সালে মেলিন্ডা গেটসকে বিয়ে করেন যিনি বর্তমানে মাইক্রোসফটের একটি গুরুত্বপূর্ন পদে রয়েছেন। এবং বর্তমানে তাদের Rory, Phoebe ও Jennifer নামের তিনটি সন্তান রয়েছে।
বিল গেটস এর প্রাথমিক জীবন
বিল গেটস এর পিতা উইলিয়াম গেটস ছিলেন একজন সিনিয়র আইনজীবী এবং তার মা মেরি ছিলেন একটি প্রধান ব্যাংকের নির্বাহী। ছোটবেলা থেকেই তার মায়ের ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে বিল তার বাবার মত বিখ্যাত আইনজীবী হবে। কিন্তু সে ইচ্ছে আর পূরণ হয় নি। বিল গৎবাঁধা পড়াশোনার চাপে বিরক্ত হয়ে পড়তেন। ১৩ বছর বয়সে অর্থাৎ সেভেন্থ গ্রেডে থাকার সময় তাকে পাবলিক স্কুল থেকে এনে সিয়াটলের বিখ্যাত প্রাইভেট স্কুল “লেকসাইড স্কুল”-এ ভর্তি করানো হয়। এখানে সব অভিজাত পরিবারের সন্তানরা পড়তো। এই স্কুলে তার জীবনের মোড় ঘুরে। মূলত সেভেন্থ গ্রেড থেকে শুরু করে হাই স্কুলের সমাপ্তি পর্যন্ত এই পাঁচ বছরের সময়টা আজকের বিল গেটসের গড়ে ওঠার সময় বলা হয়। সে সময় যেসব অসাধারণ সুযোগ তার সামনে এসেছিল এবং তিনি যেভাবে সেগুলোকে ব্যবহার করেছেন, এসবই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। সেই দিনগুলোর কল্যাণেই হার্ভার্ডের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছেড়ে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। তিনি যখন হার্ভার্ড ছেড়ে নিজের কোম্পানী মাইক্রোসফট শুরু করেন, তখন তার ঝুলিতে ছিলো সাত বছর ধরে প্রোগ্রামিং করার অভিজ্ঞতা। সুতরাং তার পথচলার সেই শুরুর সময়গুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১৯৬০ সালে তিনি প্রথমবারের মতো স্কুল যাওয়া শুরু করেন। এই সময়ে মাইক্রো কম্পিউটার এর আবিষ্কার হয় সারা পৃথিবীতে। তখনকার সময়ে মাইক্রো কম্পিউটার ছাড়া অন্য কম্পিউটারের দাম ছিল আকাশচুম্বি। যেগুলোর ব্যবহার বড় বড় কোম্পানি কিংবা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠানগুলোতে হতো। ছোটবেলা থেকেই বিল গেটস কম্পিউটার কিংবা কম্পিউটার টাইপ এর বিভিন্ন ডিভাইস এর প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন। বিল গেটস এবং তার বন্ধুরা সেই সময়েই মাইক্রোকম্পিউটার সম্পর্কে জানার জন্য উৎসাহী হয়ে পড়লেন এবং এক সময় তারা নিজেরাই মাইক্রো কম্পিউটারের জন্য কোড শেখা শুরু করলেন। লেকসাইড স্কুল থেকে তার কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহ জন্মে। তার মাথায় ঘুরপাক খায় কিভাবে কম্পিঊটার এত সহজে প্রোগ্রামগুলো ধরতে পারে? তার কম্পিউটারের উপর প্রোগ্রামিং এই স্কুলেই ঘটে। তিনি প্রথম প্রোগ্রাম তৈরি করেছিলেন এই স্কুলেই। যার নাম ছিল ‘Tic-tac-toe’। তার প্রোগ্রামিং জীবনের সূচনা হয়েছিলো এই স্কুলের একটি সংগঠনের হাত ধরে। এই স্কুলে অভিভাবকদের একটি সংস্থা ছিলো, যেটির নাম “মাদার্স ক্লাব”। এটি প্রতি বছর স্কুলের পেছনে ব্যয় করার জন্য টাকা উত্তোলন করতো। বিল এখানে আসার পরের বছর মাদার্স ক্লাব থেকে একটি অসাধারণ উদ্যোগ নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় মাদার্স ক্লাবের অর্থ দিয়ে স্কুলে একটি কম্পিউটার ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হবে। ১৯৬৮ সালের মতো সময়ে প্রায় তিন হাজার ডলার খরচ করে গঠিত হয় কম্পিউটার ক্লাব। স্কুল ও গেটসদের কাছে তখন কম্পিউটার ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর একটি বস্তু। কারণ কম্পিউটার প্রযুক্তির তখন সবে সূচনা শুরু হয়েছে। স্কুলে একটি টার্মিনাল স্থাপন করা হয়েছিলো, যা সংযুক্ত ছিল সিয়াটল শহরের মেইনফ্রেম কম্পিউটারের সাথে। তাই স্কুলে বসে টেলিটাইপিংয়ের মাধ্যমে বাচ্চারা কম্পিউটারে কাজ করতে পারতো। কম্পিউটারে কাজ করার এ পদ্ধতিটিকে বলা হতো টাইম শেয়ারিং সিস্টেম। এটি আবিষ্কৃত হয়েছিলো কেবল ১৯৬৫ সালে। এর আগে কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং করতে হতো পাঞ্চ কার্ডের মাধ্যমে, পাঞ্চ কার্ডে কোড প্রিন্ট করিয়ে নিয়ে জমা দিতে হতো অপারেটরের কাছে। তার ওপর কম্পিউটারগুলো একবারে মাত্র একটি নির্দেশ সম্পাদন করতে পারতো, তাই নিজের প্রোগ্রাম যাচাই করার জন্য দরকার হতো এপয়েন্টমেন্ট। মোদ্দাকথা অনেক ঝক্কি-ঝামেলার ব্যপার ছিলো। ১৯৬৫ সালে টাইম শেয়ারিং এসে সেসব থেকে মুক্তি দেয়। এরপর কম্পিউটার একসাথে অনেক কাজ করতে সক্ষম হয়। এবং মেইন কম্পিউটারের কাছে যাওয়া লাগে না, একটি টার্মিনালের সাথে সংযুক্ত করে সেখান থেকেই কাজ করা যায়।
স্কুলে কম্পিউটার ক্লাবটি গেটসদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। এই অদ্ভুত যন্ত্রটি কীভাবে কাজ করে তা শিখতে মেতে উঠে সবাই। মেইনফ্রেম কম্পিউটার থেকে সময় (কম্পিউটার টাইম) কিনে নিয়ে তারা এই টার্মিনালে কাজ করতেন। অবশ্য এটি বেশ ব্যয়বহুল ছিলো। আর তাই মাদার্স ক্লাবের সেই তিন হাজার ডলার ফুরিয়ে যেতে বেশিদিন লাগেনি। অভিভাবকরা আবার টাকা তুললেন, এবং সবাই তা ব্যয় করতে লাগলো। এভাবেই বিল গেটস কম্পিউটারের সাথে পরিচিত হয়, আর সেখান থেকেই শুরু হয় তার সফটওয়্যার জায়ান্ট মাইক্রোসফটের বীজ বোনা। বলা বাহুল্য, মাইক্রোসফটের আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা পল অ্যালেনও ছিলেন সেই লেকসাইড স্কুলেরই একজন ছাত্র এবং বিল গেটস এর খুব কাছের বন্ধু।
এরপর ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের একদল প্রোগ্রামার মিলে কম্পিউটার সেন্টার কর্পোরেশন (সি কিউব) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করে। তারা একটি প্রকল্প হাতে নেয় যেটার অধীনে তাদের কিছু সফটওয়্যার পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিনিময়ে তারা ফ্রীতে ‘কম্পিউটার টাইম’ দেবে। সৌভাগ্যবশত সি কিউবের এক কর্মকর্তার ছেলে তখন পড়তো গেটসদের লেকসাইড স্কুলে। সেই সুবাদে লেকসাইড কম্পিউটার ক্লাব ফ্রীতে কম্পিউটার টাইম পেয়ে যায়। স্কুল শেষে গেটসরা চলে যেতো ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের সি-কিউবের অফিসে। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতো প্রোগ্রামিং। কিন্তু কিছুদিন পর সি কিউব বন্ধ হয়ে যায়। তাই গেটসরা ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে শুরু করে যদি কোনো সুযোগ মেলে এই আশায়। কাকতালীয়ভাবে সুযোগও মিলে যায়, আইএসআই (ইনফরমেশন সায়েন্সেস ইনকর্পোরেটেড) নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের ফ্রীতে কম্পিউটার টাইম দেয়। তখন ১৯৭১ সাল। সে বছর আইএসআই এ কাটানো সাত মাসের মধ্যে গেটস ও তার সঙ্গীরা প্রোগ্রামিং করেছিলো প্রায় ১,৫৭৫ ঘন্টা। গড় করলে হিসেব দাঁড়ায় দৈনিক আট ঘন্টা। বিল গেটস সে সময়গুলোর স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, “প্রোগ্রামিং আমার প্রায় নেশার মতো হয়ে উঠেছিল। এর জন্য স্কুলে অ্যাথলেটিকসও ছেড়ে দিয়েছিলাম। কখনো কখনো রাতে গিয়ে হাজির হতাম অফিসে। প্রোগ্রামিং করে কাটতো আমার উইকেন্ডগুলো।”
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো কিন্তু পল অ্যালেন ও বিল গেটস একটা ঝামেলা পাকিয়ে ফেললেন। তারা কিছু পাসওয়ার্ড চুরি করতে গিয়ে পুরো সিস্টেম ক্র্যাশ করে ফেলেন। আর এজন্য তাদের বের করে দেয়া হলো। এরপর তাদের আর কম্পিউটারের ধারে-কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু তারাও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। পল অ্যালেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে ফ্রী কম্পিউটারের সন্ধান বের করে ফেললেন। মেডিক্যাল আর ফিজিক্স বিভাগে কম্পিউটার ছিল। সেখানে চব্বিশ ঘন্টাতেই বিভিন্ন কাজের শিডিউল দিয়ে দেয়া থাকতো। কি করবেন এই পথ খুঁজতে খুঁজতে তারা জানতে পারলেন ভোর তিনটা থেকে ছয়টার মধ্যে কোনো শিডিউল থাকে না। গেটস এবং অ্যালেন রাতে ঘুমানোর বদলে চলে যেতেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে।
এরপর গেটসের জীবনে আরেকটি মোড় আসে। টিআরডব্লিউ নামক একটি প্রযুক্তি কোম্পানী বিশাল পাওয়ার প্ল্যান্টকে কম্পিউটার সিস্টেমের আওতায় আনার একটি চুক্তি করে। তারা এ কাজের জন্য উপযুক্ত প্রোগ্রামার এর সন্ধান করছিলো। তাদের একজন যোগাযোগ করে আইএসআই-এর একজন প্রতিষ্ঠাতার সাথে। সে সময়ে দক্ষতা সম্পন্ন প্রোগ্রামার হাতেগোনা কয়েকজন ছিল। আইএসআই এর প্রতিষ্ঠাতা লেকসাইড স্কুলের দূরন্ত বালকদের সন্ধান দেন। এরপর বিল স্কুল থেকে একটি স্টাডি প্রজেক্ট নেন এবং এই ছুতোয় হাজির হন পাওয়ার প্লান্ট প্রজেক্টের ঐখানে। সেখানে তিনি জন নর্টন নামক একজন ব্যক্তির অধীনে কোডিং করেন। বিল পরবর্তীতে বলেছিলেন, “প্রোগ্রামিং বিষয়ে তিনি অন্য যে কারো চেয়ে নর্টনের কাছে বেশী শিখেছিলেন।” প্রশ্নের ফাঁকে বিলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ঐ সময়ের পৃথিবীতে কৈশোর বয়সী তার মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আর কতজন ব্যক্তি ছিলো?” তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “গোটা পৃথিবীতে সর্বসাকুল্যে পঞ্চাশজন হতে পারে। এর বেশী হলে আমি ভীষণ অবাক হব।” বিলের বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিল তাদের ছেলে উকিল হবে। বিল তেমন আগ্রহী ছিলো না, অবশ্য তার কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও ছিল না। তবে এটা ঠিক যে তার মন সবসময় কম্পিউটারের কাছে পড়ে থাকত। কৈশোরে তার অনন্যসব অভিজ্ঞতার ফলাফল ই আজকের বিল হওয়ার সূচনা ছিলো। হয়ত তিনিও বুঝেছিলেন, বাবার মতো স্রেফ সফল আইনজীবী হওয়া নয়, তার ভাগ্য লেখা রয়েছে অন্য কিছুর চূড়ায়।
১৯৭৩ সালে লেকসাইড স্কুল থেকে তার গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়। সেই সালেই তিনি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বছরে কিছু প্রোগ্রামিং সমস্যার একটা সিরিজ সমাধান করেন। ৩০ বছরের মধ্যে এটি সবচেয়ে দ্রুততম সিরিজ সমাধান ছিলো।
সময়টা তখন ১৯৭৪ সাল। বিল গেটস তখন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি তে পড়াশোনা করছেন এবং পল অ্যালেন ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি তে। এরই মাঝে পল অ্যালেন হানিওয়েল কোম্পানিতে জব করতে চলে যান। সে সময় বাজারে আসে আল্টিয়ার-৮৮০০ মাইক্রো কম্পিউটার। যেটি সেই সময়ের সবচেয়ে ভালো মানের মাইক্রো কম্পিউটার ছিলো। কোনো কারনবশত পল অ্যালেন একদিন এই কম্পিউটারটি নিয়ে চলে আসেন বিল গেটস এর কাছে। বিল কম্পিউটারটি ভালোভাবে লক্ষ্য করেন এবং ভাবলেন তারা এই কম্পিউটারের জন্য একটি ভালো মানের সফটওয়্যার তৈরি করবে। যেই ভাবা সেই কাজ, পল অ্যালেন চলে গেলেন আল্টিয়ার কোম্পানির কাছে। গিয়ে তাদের বললেন, “এই কম্পিউটারের জন্য একটি ভালো মানের সফটওয়্যার আছে আমাদের কাছে।” অথচ তাদের কাছে তখন সফটওয়্যার এর ডিজাইনও ছিল না। এরপর কোম্পানিটি পল অ্যালেন কে চমকে দিয়ে তার কাছে সফটওয়ারটিতে চেয়ে বসলেন। এটি শুনে বিল ও পল মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ সফটওয়্যার তৈরি করলেন এবং কোম্পানির কাছে জমা দেওয়ার জন্য নিয়ে গেলেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য সেই সময় সফটওয়ারটি কম্পিউটারের জন্য সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং পৃথিবী তখন প্রথমবারের মতো কোনো থার্ডপার্টি সফটওয়্যার দেখতে পায়। সফটওয়্যারটি অবিশ্বাস্য সফলতার পর পল ও বিল মিলে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই কোম্পানিটির ই নাম দেন মাইক্রোসফট। যার উদ্দেশ্য ছিল সফটওয়্যার ফর মাইক্রোকম্পিউটার।
মাইক্রোসফটের সূচনা
১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর, মেক্সিকোর বানিজ্য সচিবের অনুমতিক্রমে MITS এর আওতায় বিল গেটস একটি প্রতিষ্ঠান খুলেন। এটি ছিল Microsoft এর প্রথম অফিস। বিল ও পল পার্টনারশীপে অফিসটি খুলেছিলেন। নিউ মেক্সিকোর “Albuquerque” নামক এক এলাকায় অফিসটি খোলা হয়েছিলো। ১৯৭৭ সালে MITS থেকে Microsoft সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠানটি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এর উপর কাজ করতে থাকে। এরই মাঝে বিল ভাবলেন তার প্রতিষ্ঠানটি নিজ শহরে নিয়ে যাবে। তাই তিনি নিউ মেক্সিকো থেকে Microsoft কে ওয়াশিংটন শহরের Bellevue তে নিয়ে আসেন। সেখানে গিয়ে কোম্পানীর জন্য লোন খুঁজতে শুরু করেন। নতুন কোম্পানী হওয়ায় কেউই লোন দিতে রাজি নয়। অনেক চেষ্টা করে কাছের এক ব্যাঙ্ক থেকে লোন পান তিনি।
১৯৮৫ সাল ছিলো বিল গেটসের স্বপ্ন পূরনের বছর। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন নিজেদের তৈরি একটা অপারেটিং সিস্টেম তিনি বাজারে ছাড়বেন। ২০ নভেম্বর Microsoft প্রকাশ করলো তাদের প্রথম অপারেটিং সিস্টেম Windows 1.0। এরপর থেকে Microsoft এর বাজার সমৃদ্ধ হতে লাগলো। আস্তে আস্তে Microsoft বাজারে বেশ ভাল ভাবে আসন নিয়ে বসলো। একের পর এক Microsoft এর নতুন নতুন আবিষ্কার বাজারে আসলো আর ব্যাপকভাবে সাড়া ফেললো। Microsoft এর সকল ভার্সনের তালিকা নিচে হলো :-
1. Windows 1.01 (১৯৮৫)
2. Windows 1.02 (১৯৮৬)
3. Windows 1.03 (১৯৮৬)
4. Windows 1.04 (১৯৮৭)
5. Windows 2.01 (১৯৮৭)
6. Windows 2.03 (১৯৮৭)
7. Windows 2.11 (১৯৮৯)
8. Windows 3.0 (১৯৯০)
9. Windows 3.1 (১৯৯২)
10. Windows NT 3.1 (১৯৯৩)
11. Windows Workgroups 3.11 (১৯৯৩)
12. Windows 3.2 (১৯৯৪)
13. Windows NT 3.5 (১৯৯৪)
14. Windows NT 3.5.1 (১৯৯৫)
15. Windows 95 (১৯৯৫)
16. Windows NT 4.0 (১৯৯৬)
17. Windows 98 (১৯৯৮)
18. Windows 2000 (২০০০)
19. Windows ME (২০০০)
20. Windows XP (২০০১)
21. Windows XP Professional X64 (২০০৫)
22. Windows Vista (২০০৭)
23. Windows 7 (২০০৯)
24. Windows 8 (২০১২)
25. Windows 8.1 (২০১৩)
26. Windows 10 (২০১৫)
যে সকল ভার্সন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা লাভ করে সেগুলো হলো :-
1. Windows NT
2. Windows XP
3. Windows 2000
4. Windows Vista
5. Windows 7
6. Windows 8 and 8.1
7. Windows 10 latest
বিল গেটস এর অপারেটিং সিস্টেম সফটওয়্যার ছাড়াও অন্যান্য সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট রয়েছে, সেগুলো হলো:-
1. Microsoft 365
2. Microsoft Word
3. Microsoft Teams
4. Microsoft OneDrive
5. Microsoft OneNote
6. Microsoft Outlook
7. Microsoft PowerPoint
8. Microsoft Excel
9. Microsoft Access
10. Microsoft Project
11. Microsoft Publisher
12. Microsoft Visio
13. OneDrive
14. Microsoft Sway
15. Microsoft Forms
16. Microsoft SharePoint
17. Microsoft To-Do
18. Microsoft Lens
এছাড়াও আরও অন্যান্য…….
উইন্ডোজ এর জনপ্রিয়তা
সফটওয়্যার মার্কেটে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমটি খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়তা পায়। উইন্ডোজ জনপ্রিয়তা এর পিছনে কারণগুলো হলো :-
১. Easy to use – উইন্ডোজ সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেই সময়ের মার্কেটে অপারেটিং সিস্টেমগুলোর মধ্যে এটি ছিলো খুব সহজলভ্য।
২. Easy graphical user interface :- গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস উইন্ডোজকে জনপ্রিয় করে তোলার আরও একটি কারণ। সেই সময়ের অন্যান্য সফটওয়্যারগুলো command based operation মডেলে কাজ করতো কিন্তু উইন্ডোজ ছিলো একমাত্র সিস্টেম যেটি ছবির মাধ্যমে বা Option click বা button ক্লিক করার মাধ্যমে কাজের ধারণা নিয়ে আসতো।
৩. Advance software :- বিল গেটস এর অনেক বছরের প্রোগ্রামিং অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকার কারণে সেই সময় উইন্ডোজ এত বেশি অ্যাডভান্স হয়ে উঠে। বিল গেটস বেশি বেশি আপডেট করতেন উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে এবং উইন্ডোজ এর বিভিন্ন ভার্সন বের করতে থাকেন।
মাইক্রোসফটের বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যতগুলো কম্পিউটার ব্যবহৃত হয় তার ৭০-৭৫% কম্পিউটার মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত। বিগত বছরে বিশ্বসেরা ম্যাগাজিন সোর্সের ১০০ কোম্পানির তালিকার মধ্যে মাইক্রোসফট এর অবস্থান ১৬ তে রয়েছে। বর্তমানে মাইক্রোসফটের মালিকানাধীন রয়েছে অসংখ্য কম্পানি। যার মধ্যে রয়েছে ইয়াহু, এমএসডিএন, নোকিয়া, হলোলেন্স, এক্সবক্স, হটমেইল, লিংকডইন, স্কাইপ, বিং, গিটহাব সহ আরো অনেক কোম্পানি। এরকম ২২৬ টি কোম্পানিকে মাইক্রোসফট নিজের অধীনে করে নিয়েছে। যা কোনো না কোনোভাবে মাইক্রোসফট এর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার মতো পর্যায়ে ছিল। মাইক্রোসফট এগুলোকে নিজের করে নেয়। এখানেই শেষ নয় বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়ে এমন আরো ১০০ টির বেশি কোম্পানি রয়েছে যেগুলোতে সরাসরি মাইক্রোসফটের সাথে শেয়ার রয়েছে। উদাহরণ স্বরুপ আমেরিকার বিখ্যাত বেস্টবাই এবং অ্যামাজনের মালিকানাধীন অডিওঅ্যাবল ডটকমের কথা ই বলা যায়। মাইক্রোসফটের শেয়ার রয়েছে ফেসবুকের সাথেও। মাইক্রোসফট বর্তমানে আমেরিকার বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে আছে। যা ট্রিলিয়ন ডলার উপার্জন করার গৌরব অর্জন করেছে। এর আগে এ রেকর্ড ছিলো শুধু মাত্র অ্যাপেল ও অ্যামাজনের। ২০১৮ সালে পশ্চিম গ্লোবাল, ৫০০ কোম্পানির তালিকায় মাইক্রোসফট এর অবস্থান হয় ৩০ তম। ২০১৫ সালে মাইক্রোসফট বাজারে রিলিজ করে উইন্ডোজ-১০। এটি এতোটাই জনপ্রিয় হয় যে, বর্তমানে সারাবিশ্বে প্রায় ৪৫% কম্পিউটারে এই অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার হচ্ছে।
বর্তমানে সারাবিশ্বে মাইক্রোসফট এর রয়েছে ১ লক্ষ ৫১ হাজার ১৬৩ জন কর্মী। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে মাইক্রোসফট আয় করেছে ১২৫.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যেখানে মাইক্রোসফট এর নিট ইনকাম ছিলো ৩৯.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাইক্রোসফট নিয়ে এসেছে মাইক্রোসফট সারফেস যার ফলে তারা সফটওয়্যার থেকে হার্ডওয়ার এর মার্কেটেও নিজেদের অবস্থান করে নিতে শুরু করেছে।
সাফল্যের সাথে বিল গেটসের যশ, খ্যাতি, ক্ষমতা, সম্মান এবং অর্থ বাড়ে। মাত্র ৩২ বছর বয়সে অর্থাৎ, ১৯৮৭ সালে Fobers পত্রিকায় ৪০০ বিলিওনিয়ারের মধ্যে বিল গেটস এর নাম চলে আসে। নিজের আত্মপ্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা সবচেয়ে কম বয়স্ক বিলিয়নার হিসেবে তখন তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিছুদিনের মধ্যেই আরো যোগ হয়ে হয় ৯০০ বিলিয়ন ডলার। Fobers পত্রিকা জরীপ অনুযায়ী, ২০৯৩-২০০৭ সাল পর্যন্ত টানা ১৬ বছর বিশ্বের ১ নাম্বার ধনী ব্যক্তি ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্টের বিখ্যাত Times ম্যাগাজিন এর, “One of the 100 people who most influenced the 20th century” এর তালিকায় ১ম স্থানে থাকেন। বিল গেটস প্রতি মাসে আনুমানিক ৩০০ মিলিয়ন ডলার আয় করে, যা বাংলাদেশী টাকায় ২ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা । এছাড়াও বিল গেটসের সমস্ত সম্পত্তির পরিমাণ ধারণা করা হয় যে, ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক।
তবে তিনি তার অধিকাংশ আয় দান করে দেন। তার বেশ কিছু চ্যারিটেবল ট্রাস্ট রয়েছে। এছাড়াও ২০০০ সালে তিনি এবং তার স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস দুইজন মিলে একটি চ্যারিটি ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন, যার নাম হচ্ছে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশন এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেবামূলক কাজ করা। বিল গেটস যত টাকা আয় করেন তার সিংহভাগ অংশ ফাউন্ডেশনে খরচ করেন। বিল গেটসের গঠিত এই চ্যারিটেবল ট্রাস্ট হচ্ছে আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে বড় ট্রাস্ট ফাউন্ডেশন। তার গঠিত এই চ্যারিটেবল ট্রাস্ট এর মোট সম্পত্তির পরিমাণ হচ্ছে ৬.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিল গেটসের ট্রাস্ট এর তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো :-
- চরম দরিদ্রতা থেকে মানুষকে বের করে আনা
- মানুষকে ইনফরমেশন টেকনোলজির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া
- মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করা
ছোট একটি ঘটনা দিয়ে আজকের আলোচনাটি শেষ করি। একদিন বিল গেটসকে এক উপস্থাপিকা জিজ্ঞেস করলো, “জনাব গেটস, আপনার সফলতার গোপন রহস্য কী?” বিল গেটস উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে একটি ব্ল্যাংক চেক বই সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “আপনার যতো টাকা ইচ্ছা লিখে নেন।” উপস্থাপিকা চেকটি ফিরিয়ে দিলেন এবং প্রশ্নটি আবার করলেন। বিল গেটস আবার চেকটি অফার করলেন। উপস্থাপিকা চেকটি ফিরিয়ে দিলেন এবং প্রশ্নটি আবার করলেন। বিল গেটস উপস্থাপিকার দিকে তাকালেন এবং উত্তর দিলেন, “সফলতার গোপন রহস্য হলো, আমি কখনো সুযোগ হাত ছাড়া করি নি, যেভাবে আপনি এইমাত্র করলেন। আপনার যদি এরকম মাইন্ডসেট থাকত তাহলে আপনি হয়ে যেতেন বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তশালী উপস্থাপিকা। চলার পথে যত সুযোগ আসবে, ছিনিয়ে নিতে হবে। আর তখনই সফল হওয়া যাবে, যখন সুযোগ কাজে লাগিয়ে একশনে যেতে পারবেন।”
অন্যসব বেশিরভাগ সফল উদ্যোক্তাদের মতো, বিল গেটসের সাফল্যের অন্যতম কারণগুলো ছিলো কঠোর পরিশ্রম, বুদ্ধি, সঠিকভাবে সময় ব্যবহার, ব্যবসায়িক জ্ঞান এবং ভাগ্যের সংমিশ্রণ। গেটস ক্রমাগত তার কর্মীদের কঠোর পরিশ্রম করতে বলেন এবং তিনি নিজে তাদের থেকেও কঠোর পরিশ্রম করেন। গেটস ঝুঁকি নিতে ভয় পান না। সুযোগ পেলেই এটির সঠিক ব্যবহার করেন। কখনো পিছপা হননি, সময়কে ব্যবহার করেছেন সঠিক নিয়মে। যার ফলস্বরূপ তিনি আজকের বিল গেটস। এই ছিলো আজকের আলোচনা। যেকোনো প্রশ্ন জাগলে নির্দ্বিধায় কমেন্টবক্সে কমেন্ট করুন। এবং টেকনোলজি সম্পর্কে যেকোনো তথ্য জানতে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। ধন্যবাদ।