আমাদের সাথে প্রায়ই অবাক করা কিছু না কিছু জিনিস ঘটে। কখনো আমরা তা প্রত্যক্ষভাবে চোখে দেখতে পাই, কখনো তা মস্তিষ্ক বা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করি। এরকমই একটি অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে দেজা ভ্যু। আমরা অনেক সময় অনেক জায়গায় ঘুরতে যাই। তখন এমন হয় যে সেই অচেনা জায়গায়টিতে এক অদ্ভুত অনুভুতি মনের মধ্যে আসতে থাকে। মনে হতে থাকে, এই অচেনা জায়গা এর আগে কোথাও দেখেছি বা এই জায়গায় কখনো এসেছি এরকম একটা টান অনুভব হয়। কিংবা হঠাৎ করে মনে হয় বর্তমানের এই ঘটনাটি আমার সাথে আগে হয়েছে। এই বিষয়গুলোকেই দেজা ভ্যু বলে অভিহিত করা হয়। দেজা ভ্যু খুবই সাধারন একটি ঘটনা। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, “দুনিয়ার প্রায় ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ কম বেশি এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়।” সাউদার্ন মেথোডিস্ট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী অ্যালান এস. ব্রাউন ২০০৩ সালে তার এক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে জানান, “পৃথিবীর ৭০ ভাগের বেশি মানুষ তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময় এই পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন।” ২০০৪ সালে প্রায় ৫০ জন লোকের উপর গবেষণা করে জানা যায়, “পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ লোকের সাথে জীবনে অন্তত একবার হলেও দেজা ভ্যু হয়েছে। অনেকের হয়ত একাধিকবার দেজা ভ্যু হয়েছে।” এমনকি যারা জন্ম থেকেই অন্ধ তারাও দেজাভুর সম্মুখীন হয়েছে।
দেজা ভ্যু – (Déjà vu) শব্দটি ফরাসি ভাষা থেকে এসেছে। যেটির বাংলা অর্থ হলো ‘ইতোমধ্যে দেখা’। এর অন্য নাম হচ্ছে পারামনেসিয়া, যা মূলত গ্রিক শব্দ “প্রোমনেসিয়” থেকে এসেছে। প্রোমনেসিয় শব্দটির উৎপত্তি παρα এবং μνήμη নামের দুটি গ্রিক শব্দ থেকে। παρα শব্দের অর্থ নিকটে এবং μνήμη শব্দের অর্থ স্মৃতি। একত্রে পারামনেসিয়া অর্থ হচ্ছে এমন একটি নিশ্চিত অনুভবের অভিজ্ঞতা যা একজন ইতোপূর্বে সম্মুখীন হয়েছে অথবা স্বচক্ষে দেখেছে। সহজ ভাষায়, কোনো ব্যক্তির একটি পরিস্থিতি বা দৃশ্য দেখে হঠাৎ করে তা আগে থেকে পরিচিত মনে হওয়ার অনুভূতিই হচ্ছে দেজা ভ্যু।
দেজা ভ্যু শব্দটি প্রচলিত হবার আগে থেকেই বিভিন্ন সাহিত্যিক এবং মনস্তাত্ত্বিকের লেখনীতে এই ধরনের পরিস্থিতির বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু তখন পুরো বিষয়টি এককথায় প্রকাশের জন্য কোনো নাম ছিলো না। ফরাসির মানসিক বিশ্লেষক এমিল বোইরেক সর্বপ্রথম এই নামটি ব্যবহার করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন তিনি মানসিক বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ (L’Avenir des sciences psychiques) নামের একটি বই লিখেন। বইটির একটি প্রবন্ধে তিনি দেজা ভ্যু শব্দ দুটি ব্যবহার করেছিলেন।
সুইচ গবেষক আর্থার ফাঙ্কহাউজার দেজা ভ্যু প্রক্রিয়াটিকে (déjà experiences) বোঝার সুবিধার জন্য অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দুটো ভাগে ভাগ করেন।
– এমন অভিজ্ঞতা যা ইতোপূর্বে দেখা বা পরিদর্শন করা হয়েছে, যা ফরাসি ভাষায় déjà visité বলা হয়।
– এমন অভিজ্ঞতা যা ইতোপূর্বে অনুভব করা হয়েছে, যা ফরাসি ভাষায় déjà vécu বলা হয়।
আমেরিকান বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত গবেষণার উপর ভিত্তি করে, দেজা ভ্যু প্রভাবের উপস্থিতির একটি তত্ত্ব তৈরি করা হয়েছিলো। এই তত্ত্বের ভিত্তি হলো, যখন মস্তিষ্কের একটি অংশ অস্থায়ী ও কর্মহীন থাকে, তখন একজন ব্যক্তি বাস্তব এবং কল্পনার মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যেকোনো ঘটনা/ দৃশ্য/ অনুভূতি পরিচিত মনে হলেও ব্যক্তির মধ্যে তা নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা কাজ করে। কারণ হিউম্যান ব্রেইন কম্পিউটারের মত সুনিপুণভাবে সব ইনফো সেভ করে রাখতে পারেনা। ব্রেইন মেমোরির একাংশ ভালোভাবে সেভ করে, আরেকাংশ অস্পষ্ট হয় বা মুছে যায়। কোনো একটি বিশেষ স্মৃতির কিছু অংশ দেখলে ব্রেইনের টেম্পোরাল লোব উত্তেজিত হয়ে পড়ে। যদি পুরো মেমোরিটা সে রিকল করতে পারে, তখন কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা তখন হয় যখন মেমোরি অর্ধেক রিকল করতে পারছে কিন্তু বাকি অর্ধেক পারছেনা, এই রকম সিচুয়েশনে ব্রেইন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এই সিচুয়েশনকেই দেজা ভ্যু বলে আখ্যায়িত করেছেন বিজ্ঞানীরা।
দেজা ভ্যু কেন হয়?
দেজা ভ্যু বিষয়টি নিয়ে অনেক গবেষক কাজ করেছেন। অতীত থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অনেকেই তাদের গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে নানা রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্যাখ্যাগুলো বিশ্লেষণ সাপেক্ষে দেজা ভ্যু হওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় প্রভাবক হিসেবে উঠে আসে। সেগুলো হলো :-
- স্বপ্নের প্রভাব,
- অতীত স্মৃতির প্রভাব এবং
- মস্তিষ্কের প্রভাব।
তবে দেজা ভ্যু এর আসল রহস্য এখনো পুরোপুরি উদ্ঘাটন হয় নি। বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের দুটো চোখে মাঝে মাঝে ভিজুয়াল ইনফর্মেশন একটা চোখের চাইতে অন্য চোখ যখন সামান্য দ্রুত পাঠায় এবং অন্য চোখ ঐ ইফর্মেশন একটু পরে পাঠায়, তখন আমাদের মস্তিস্ক একই ভিজুয়াল ইনফরমেশন দুইবার প্রসেস করে। তাই মনে হয় এই ঘটনাটা এর আগে কোথাও হয়েছে। এবং এটি ই দেজা ভ্যু। সাইকোলজি বলে, দেজা ভ্যু হবার কারণ হলো অলস ক্রিয়েটিভ মাইন্ড ৷ উক্ত ব্যক্তি যা যা দেখেছেন এবং শুনেছেন তার সবগুলো থেকে অবচেতন মন একটু একটু করে তথ্য নিয়ে একটা কল্পনার জগৎ তৈরী করে। অনেক ক্ষেত্রে কাহিনীও তৈরী করে। যার সব না মিললেও কিছু কিছু মিলে যায় পরবর্তীতে। যেগুলো মিলে যায় ঐগুলোকেই মনে হয় দেজা ভ্যু। আরও সহজ যে উত্তর রয়েছে সেটি হলো, আমাদের পূর্ব জীবনে আমরা এই জায়গায় এসেছিলাম এবং এই ধরনের অনুভূতি হওয়ার পেছনে এটাই একমাত্র কারণ। অনেক গবেষক এই ব্যাখ্যাতে খুশি হয়ে যায়। কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়। কেউ কেউ বলেন যে পূর্ব জন্ম বিষয়টি এখানে কোনো উত্তর নয় । তাদের মতে, হয়তো বা কেউ কোনো কিছু অবচেতন ভাবে শুনেছিলো আর তার মন সেটিকে সযত্নে রেখে দিয়েছিলো। এবং পরবর্তীতে সাদৃশ্য পাওয়ায় দেজা ভ্যু হয়েছে। এখানেই বিষয়টি থেমে যায় নি, মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা চেয়েছিলেন এই অনুভূতিকে মানসিক রোগ বলতে, নামও দেওয়া হয়েছিল “Temporal Lobe Epilepsy”। এই ধারনা কিছু গবেষককে আগ্রহী করে তুলেছিলো। কিন্তু শেষমেশ এই ধারনাটিও তেমন ভাবে ভিত্তি পায়নি। সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, দেজা ভ্যু প্রক্রিয়াটি স্মৃতির সাথে সম্পর্কিত। একটি ধ্বনি যেমন হঠাৎ করে আমাদের জিহ্বার ডগায় চলে আসে, ঠিক তেমনি কোনও স্মৃতি হঠাৎ করেই আমাদের ব্রেইনে চলে আসতে পারে। কিন্তু এখানে সমস্যা হচ্ছে- জাগ্রত এই স্মৃতি পুরোপুরি একটি অবচেতন প্রক্রিয়ায় হয়, যা অনেকটা স্বপ্নের মতো।
দেজা ভ্যু কখন হয়?
দেজা ভ্যু এর কোনো ধরাবাঁধা সময় নেই। কখন কোন সময় ঘটবে বা আদৌ ঘটবে কিনা তা আগে থেকে বোঝা যায় না। তবে স্নায়ু চিকিৎসক, মনোবিদ, এবং বিজ্ঞানীরা ঘটনার ধরন দেখে বুঝবার চেষ্টা করেছেন যে কখন এই ধরনের অনুভূতি কেউ পেতে পারে।
১. বেড়াতে গেলে ‘দেজা ভ্যু’ হয় :- দেজা ভ্যু গবেষক ক্রিস মোলিনের মতে, “যখন আমরা নতুন কোন জায়গা বা অভিনব কোন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই, তখনই এই অনুভূতিটা সবচেয়ে প্রবল হয়।” তার মতে, একেবারে অপরিচিত জায়গায় গিয়ে যখন আমাদের জায়গাটা চেনা বলে মনে হতে থাকে, আবার এটাও মনে হয় যে সেখানে আমরা আগে কখনো যাই নি, তখন এই দুইয়ের মধ্যে বিরাট দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ যত বেশি ভ্রমণ করে, তত বেশি ‘দেজা ভ্যু’র অনুভূত হয়।
২. তরুণ বয়সীদের বেশি ‘দেজা ভ্যু’ হয় :- কমবয়সে মূলত একজন ব্যক্তির ঘন ঘন দেজা ভ্যু হয়। তবে মাসে একবারের বেশি নয়। যখন একজন ব্যক্তির বয়স ৪০ বা ৫০ হয়, তখন দেজা ভ্যুর হার কমে আসে। আর বয়স ৬০ পেরিয়ে গেলে দেজা ভ্যু হবেই না বললে চলে।
ধারণা করা হয়, ছোট বাচ্চারা দেজা ভ্যু অনুভব করে না, কারণ তাদের অবচেতনভাবে এখন পর্যন্ত কোনো পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করা যায় নি। কিছু বিশেষজ্ঞের অভিমত, “শিশুরা দেজা ভ্যু’টিকে অস্বাভাবিক কিছু মনে করে না। কারণ, তারা এখন রূপকথায় বিশ্বাস করে। এবং একটি ছোট শিশু নির্ভরযোগ্যভাবে কোনও প্রাপ্তবয়স্ককে তার সাথে কী ঘটছে তা ব্যাখ্যা করতে পারে না, তার অনুভূতি জানাতে পারে না।” তবে, বয়ঃসন্ধিকালে দেজা ভ্যু এর প্রভাব বেশ সাধারণ। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, দেহের নিবিড় পরিপক্কতা, বয়ঃসন্ধি এবং হরমোনীয় স্তরের পরিবর্তন।
বর্তমানে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, দেজা ভ্যু এর প্রভাব মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না, মস্তিষ্কের কাজে ব্যাঘাত ঘটবে না এবং মানসিক ক্ষমতা দুর্বল করে না। সুতরাং, আমাদের দেজা ভ্যু এর প্রভাব থেকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই। এই জাতীয় অবস্থা তৈরী হওয়ার সময়, আমাদের শান্ত থাকতে হবে এবং নিজেকে ব্যস্ত করতে হবে অন্য কাজে, বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। যেহেতু দেজা ভ্যু এর প্রভাবটি দীর্ঘ সময়ের জন্য কখনোই ঘটে না। ঘন ঘন দেজা ভ্যু এর মুখোমুখি হওয়া টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সির কারণে হতে পারে। কিন্তু দু’একবার এটির অভিজ্ঞতা হলে এটি নিয়ে দুশ্চিন্তা করা উচিত নয়, এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। পৃথিবীর প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ই জীবনে কোনো না কোনো সময়ে এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। তাই এটি যদি হরহামেশা না ঘটে তাহলে তা নিয়ে চিন্তা না করে বরং তা উপভোগ করতে হবে। মূলত দেজা ভ্যু হলো মানবমস্তিষ্কের এক জটিল খেলা, এই খেলার ধাঁধা এখনো মেলেনি। কিন্তু আশা রয়েছে, বিজ্ঞান নিশ্চয়ই কোনো একদিন এর সঠিক সমাধান দিবে।
এই ছিলো দেজা ভ্যু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। যেকোনো প্রশ্ন জাগলে নির্দ্বিধায় কমেন্টবক্সে কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।